৩৬ জুলাই, ২০২৫। আমাদের স্বাধীনতার নতুন এক সূর্যোদয়ের এক বছর পূর্তি। গত বছরের এই দিনটিতে, এক নির্মম শ্বাসরুদ্ধকর ইতিহাসের অবসান ঘটেছিল। ১৫ বছরের একচ্ছত্র শাসন, রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ, মত প্রকাশের অবরোধ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অবসান ঘটিয়েছিলো আজ। এ দেশের অদম্য ছাত্রজনতা, পেশাজীবী, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, সাংবাদিক, সাধারণ জনগণ এবং বাংলাদেশের চেতনাসম্পন্ন প্রতিটি হৃদয় স্বস্তি পেযেছিল।
সেদিন সকাল থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিলো কোটি প্রাণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠেছিলো মুক্তির মশালবাহী। তাদের একদফা ছিলো—ফ্যাসিস্ট হাসিনার পদত্যাগ। তাদের কণ্ঠে ছিলো জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি। রাষ্ট্রের পোষ্য বাহিনীগুলো যতই গুলি চালাক, লাঠিচার্জ করুক, রক্তাক্ত করুক; ছাত্রজনতার অঙ্গীকার ছিলো অনড়, দৃঢ়, আপসহীন। যুদ্ধ চলছিল বাংলাদেশ বনাম আওয়ামী ফ্যাসিবাদ সরকার।
এই বিপ্লব শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছিলো। দিল্লি, ইসলামাবাদ, লন্ডন, নিউইয়র্ক, বার্লিন—সবখানে বাংলাদেশের ‘৩৬ জুলাই বিপ্লব’ আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিলো। কেউ কেউ বলেছিলো, এটি ২১ শতকের ‘ডিজিটাল মুক্তিযুদ্ধ’। কেউ কেউ বলেছিলো, গণমানুষের চেতনার জাগরণ। পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ আন্দোলন হোক বা ভারতের মনুবাদবিরোধী ছাত্র আন্দোলন—বাংলাদেশের ৩৬ জুলাইকে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করেছে অনেকে। আর আমরা, বাংলাদেশের নাগরিকরা, বলেছিলাম—“সাবাস বাংলাদেশ!”
কিন্তু আজ, এক বছর পর, আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? এই প্রশ্নে জর্জরিত আমার মন। আমার আশা ছিলো, ৩৬ জুলাই ২০২৫ হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাতীয় ঐক্যের উৎসব। সকল দল, মত, পথ, পেশা নির্বিশেষে একত্রে দাঁড়িয়ে এই দিনে বলবে—আমরা মানুষ, আমরা মুক্ত, আমরা গণতন্ত্র চাই।
কিন্তু বাস্তবতা বড়ই করুণ। আজকের ৩৬ জুলাইয়ে আমরা দেখলাম—বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের মতো করে দিবসটি পালন করলো। কেউ করলো র্যালি, কেউ করলো আলোচনা সভা, কেউ করলো শহীদ স্মরণ। কিন্তু কোথাও নেই একটি যৌথ কর্মসূচি, নেই কোনো জাতীয় ঐক্যের প্রকাশ। সবাই আলাদা, খণ্ডিত, একা। ঠিক যেন, একটি গোলাপের বিচ্ছিন্ন পাপড়ি।
তাহলে কি আমরা আবারও সেই বিভাজনের পথে হাঁটছি? ইতিহাস কি আবারও একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে?
আমরা ভুলে যাচ্ছি, ৩৬ জুলাই ছিলো কোনো একক দলের জয় নয়। এটি ছিলো একটি জাতির বিজয়। এটি ছিলো জনগণের সেই চূড়ান্ত অবস্থান যেখানে ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্র ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে গর্জে উঠেছিলো। এই দিনটির আবেদন দলীয় নয়—জাতীয়। এটি যেনো একটি নতুন মহান স্বাধীনতা দিবস।
অথচ আজ আমরা বিভক্ত। রাজনৈতিক দলগুলো যেন আবার নিজেদের সংকীর্ণ ব্যানারে নিজেদের গৌরব বাঁচাতে ব্যস্ত। বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপি অবশ্যই এই জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে পারতো। জামাতে ইসলাম, এনসিপি, বিপ্লবী ছাত্রদল বা অন্যান্য নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোও একসঙ্গে একত্রে এই দিনটি উদযাপনের উদাহরণ তৈরি করতে পারতো।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে কেউই সেই দায় নেয়নি।
আমরা একথা ভুলে যাচ্ছি, একসময় যারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিলো—তারাই শেষ পর্যন্ত তাদের হাতে নিপীড়িত হয়েছে। আওয়ামী লীগ নামধারী দলটি কোনো রাজনৈতিক আদর্শের ধারক ছিলো না, বরং একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রযন্ত্রে পরিণত হয়েছিলো। এমনকি তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও একসময় রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার শিকার হয়েছে। তাই ইতিহাসের শিক্ষা একটাই—রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যই একমাত্র মুক্তির পথ।
এই ঐক্য যদি ২০২৫ সালের ৩৬ জুলাইয়ে আরও একবার দৃশ্যমান হতো, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের মর্যাদা অনেকগুণ বেড়ে যেতো। ইউএন, এ্যামনেস্টি, টিআইবি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, এমনকি ভারতীয় সরকার পর্যন্ত উপলব্ধি করতো যে—বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোনো আপোষে রাজি নয়। ভারতও হয়তো আর কখনো হাসিনার মতো একজন ‘পুশ-ইন’ কুশীলবকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানোর দুঃস্বপ্ন দেখতো না।
তাহলে কেন এই ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলো না?
অহংকার, আত্মম্ভরিতা, দলীয় বিভাজন, নেতৃত্বের সংকট—এই চারটি বিষ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে গ্রাস করেছে। অথচ জনগণ প্রমাণ করেছে, তারা ঐক্যবদ্ধ হলে ইতিহাস বদলে দিতে পারে। ৩৬ জুলাই তার জীবন্ত উদাহরণ।
তাই আজকের দিনটিতে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন ফ্যাসিবাদবিরোধী কণ্ঠস্বর হিসেবে এবং একজন জাতীয়তাবাদী কর্মী হিসেবে আমি এই কথাগুলো বলছি—আমরা যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধিকার, উন্নয়ন এবং একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র গড়তে চাই, তবে জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতেই হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে—“ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।” দলীয় বিভাজনের রাজনীতি আমাদের পিছনে টানে, জাতীয় ঐক্য আমাদের সামনে নিয়ে যায়।
আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সম্মানজনক, মানবিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ রেখে যেতে হলে, ৩৬ জুলাই যেন একটি দলীয় উৎসব না হয়ে—একটি জাতীয় দিবস হয়ে ওঠে, সেটিই হওয়া উচিত আমাদের অঙ্গীকার।
সেই লক্ষ্যে চলুন, আগামী বছর থেকে এই দিনটি একযোগে উদযাপন করি। একদিনের জন্য হলেও দলমত ভুলে গিয়ে বুকে ধারণ করি, আমরা সবাই বাংলাদেশ। আমাদের ভিন্নমত থাকতে পারে, কিন্তু দেশের কল্যাণে আমাদের লক্ষ্য একটাই—ফ্যাসিবাদ নয়, গণতন্ত্র চাই। নিপীড়ন নয়, ন্যায়বিচার চাই।
৩৬ জুলাই আমাদের সেই ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকুক।
সাবাস বাংলাদেশ। সাবাস জনগণ। স্বাগতম গণতন্ত্র।