মোঃ শাহজাহান বাশার, সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার
অর্থনীতির নতুন দিগন্ত: পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে


বাংলাদেশ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপরূপ দেশ। এখানে রয়েছে সমুদ্র, পাহাড়, নদী, হাওর-বাঁওড়, চা-বাগান, মৎস্য ও পাখির অভয়ারণ্য, প্রাচীন স্থাপত্য, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি—সবই মিলেমিশে গড়ে তুলেছে বৈচিত্র্যময় এক পর্যটন সম্ভাবনা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই সম্ভাবনাময় শিল্প এখনো কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের পথে পৌঁছাতে পারেনি। সঠিক পরিকল্পনা, উদ্যোগ, অবকাঠামো ও প্রচারণার অভাবে আমাদের পর্যটন খাতটি আজও অগোচরে পড়ে আছে।
কক্সবাজারের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, সেন্ট মার্টিনের প্রবাল দ্বীপ, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিলেটের চা বাগান, রাঙামাটির পাহাড় ও লেক, মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি—এসবই বিশ্বকে মুগ্ধ করার মতো অনন্য সৌন্দর্যের প্রতীক। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যেখানে কেবল একটি পর্যটন আকর্ষণকেন্দ্র দিয়েই অর্থনীতির বড় অংশ গড়ে তুলেছে, সেখানে বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য দর্শনীয় স্থান, যা সঠিক ব্যবস্থাপনা ও প্রচারের মাধ্যমে অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তিতে পরিণত হতে পারে।
পর্যটনশিল্প হচ্ছে এমন একটি খাত, যা একই সঙ্গে বিদেশি মুদ্রা অর্জন বেকারত্ব নিরসনস্থানীয় অর্থনীতি সক্রিয়করণ এবং দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গঠন*—সবক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে। অথচ বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান এখনো ৪ শতাংশেরও নিচে। এই ব্যবধানই প্রমাণ করে—আমাদের কতটা সম্ভাবনা অপ্রয়োগ অবস্থায় পড়ে আছে।
দেশের পর্যটন এলাকাগুলোর অধিকাংশ জায়গায় যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্বল মানসম্মত হোটেল-রিসোর্টের অভাব নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা সমস্যা এবং পর্যাপ্ত তথ্য ও দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। বিদেশি পর্যটক তো দূরের কথা, দেশীয় পর্যটকরাও অনেক সময় এসব সমস্যার কারণে ভ্রমণে আগ্রহ হারান। অথচ সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগে পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন করলে, হাজার হাজার তরুণের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে।
ইকো ট্যুরিজম ও এগ্রো ট্যুরিজম সুন্দরবন, চা-বাগান, হাওর ও গ্রামীণ জীবনভিত্তিক পর্যটন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হতে পারে।রিলিজিয়াস ট্যুরিজম*: হাজীগঞ্জ, মাইজভান্ডার, চাঁদপুর, মাজার কেন্দ্রিক পর্যটন ধর্মীয় ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।কালচারাল ট্যুরিজম: বাউল, নাচ, লোকসংস্কৃতি, মেলা, ঐতিহ্যবাহী খাবার—এসব বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে।ডিজিটাল প্রমোশন*: সামাজিক মাধ্যম, ওয়েবসাইট ও ইউটিউবে দেশীয় পর্যটনের ভিডিও কনটেন্ট ছড়িয়ে দিতে পারলে প্রচারণায় বিশাল পরিবর্তন আসবে।
সরকার চাইলে এই খাতকে “অগ্রাধিকার শিল্প” হিসেবে ঘোষণা দিয়ে নীতিগত সহায়তা, কর রেয়াত, বিনিয়োগ প্রণোদনা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করতে পারে। পর্যটন বোর্ডকে আরও কার্যকর ও আধুনিক রূপে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি জেলা পর্যায়ে ট্যুরিজম ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপন ও স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরি করাও জরুরি।
পর্যটনশিল্প কোনো বিলাসী খাত নয়—এটি একটি *উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক খাত*। বিশ্ব আজ টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটছে, যেখানে পর্যটন হবে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। তাই এখনই সময়, বাংলাদেশকে এই শিল্পের প্রকৃত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে—দূরদর্শী পরিকল্পনা, সৎ নেতৃত্ব, এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারের মাধ্যমে।