পলাশ হোসেন, পাবনা
পেয়ারা চাষে ক্ষতি, মাল্টায় সাফল্য: বছরে আয় ১৫ লাখ


একসময় পেয়ারা ও কলা বাগান করেন শামীম আক্তার তুহিন। কিন্তু দফায় দফায় লোকসানে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। চাকরি ও অন্য ব্যবসা ছেড়ে কৃষিতে সফলতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন আচ্ছন্ন হয় হতাশার কালো আঁধারে। তবে এখন তাকে ঘিরে রচিত হয়েছে পদ্মার চরে সাফল্যের গল্প।
জানা যায়, পাবনা সদর উপজেলার চর তারাপুর ইউনিয়নের কোলচরী গ্রামের আব্দুল জলিল বিশ্বাসের ছেলে তুহিন। এবার দেশি জাতের বারি-১ মাল্টা চাষে ভাগ্যবদলের হাতছানি দিচ্ছে তাকে। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা চরে মাল্টা চাষের উপযোগী জমিতে ভালো ফলন ও দামে ১৮ বিঘা জমির বাগান থেকে এখন তার বছরে আয় কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা। বাগানে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানেরও। খরচের দ্বিগুণ দামে মাল্টা বিক্রি হওয়ায় মুনাফা ব্যাপক। তার দেখাদেখি এ জাতের মাল্টা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বছরের পর বছর মুড়িকাটা পেঁয়াজে লোকসান গোনা চাষিরা।
উদ্যোক্তা তুহিন বলেন, ‘২০০৯ সালে শখের বশে বরইয়ের বাগান দিয়ে শুরু করি। পরে ৫৫ বিঘা জমিতে পেয়ারায় টুকটাক আয় হতে থাকে। এরপর ১৮ বিঘায় পেয়ারা ও কলা বাগান করি। সবমিলিয়ে প্রায় ৭০ বিঘার বাগান হয়। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও করোনার কারণে সব শেষ হয়ে যায়। মোটামুটি ৫০ লাখ টাকার মতো লোকসান হয়। সবশেষ মাল্টা বাগান আবার আশা দেখিয়েছে। পদ্মার চরের মাটি বেলে-দোঁআশ বা পলিমাটি হওয়ায় ফলন ভালো হচ্ছে। শুরুতে দাম ও ফলন কম হলেও এ বছর তুলনামূলক ভালো বাজার ও ফলনে লাভজনক অবস্থায় আছি। খরচ বাদে বছরে লাখ পনেরো টাকা আয় হবে।
তিনি জানান, ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় ২০২২ সালে পদ্মা নদীর বুকে জেগে ওঠা চরের ১৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে মাল্টা চাষ শুরু করেন। চুয়াডাঙ্গার এক নার্সারি থেকে বারি-১ জাতের মাল্টার ১ হাজার ৭০০ চারা রোপণের পর প্রথমবার ৫০০ মণ ফলন পেলেও হতাশ হননি তুহিন। পরের বছরগুলোতে ৭০০ ও ৯০০ মণ করে ফলন মেলে। অনুকূল আবহাওয়ায় এ বছর কমপক্ষে ১ হাজার ২০০ মণ মাল্টা বাজারজাত করা সম্ভব হবে। বর্তমানে ২ হাজার ৫০০ টাকা মণ হিসেবে বাজারদর দাঁড়াবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা।
উদ্যোক্তা তুহিন বলেন, ‘প্রতি বছর এ সময় বাগান থেকে একবার মাল্টা তোলা হয়। বছরে দুবার সার দেওয়া বাবদ ১ লাখ টাকা, কীটনাশকে ২ লাখ, জৈব সারে ৪০ হাজার ও শ্রমিক বাবদ ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ও মাল্টা বিপণন বাবদ মোট ১২-১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। পাবনা শহর, কাশিনাথপুর ও সুজানগরের বিভিন্ন আড়ত ও দোকানির কাছে এ মাল্টা বিক্রি করা হয়।
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষ বিদেশি পণ্যের নাম শুনলে অতিরিক্ত ঝোঁক দেখায়। ফলের ক্ষেত্রেও তাই। এভাবে বিদেশি ফলের দিকে না ঝুঁকে মানুষ যদি দেশি ফল বেশি বেশি কেনে, তবে এর বাজার ভালো হবে। চাষাবাদে আমাদেরও আগ্রহ বাড়বে। বর্তমানে বাজারদর ২৪০০-২৬০০ টাকা মণ। পরে আরও বাড়বে। ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার পর্যন্ত হতে পারে।
মাল্টা বাগানে কাজ করেন শ্রমিক সানোয়ার। ৭ হাজার টাকা বেতনে কাজ শুরু করলেও লাভ বৃদ্ধি ও বাজার হিসেবে এখন পারিশ্রমিক ১৮ হাজার টাকা। বাগানে তেমন কঠোর শ্রমের কিছু নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বাগান বা ক্ষেত করার মতো মাল্টা বাগানে এত পরিশ্রম নেই। কাজও সহজ। শুরুতে গাছে ফল কম এলেও এ বছর অনেক ফল এসেছে। খেতেও সুস্বাদু। দাম ভালো পেলে মহাজনের এবার ভালো লাভ হবে।
আরেক বাগান শ্রমিক সরোয়ার বলেন, ‘শুরু থেকেই আমি বাগান মালিকের সাথে আছি। মাটি ও আবহাওয়া ভালো হওয়ায় বাগানে তেমন রোগবালাই এখনো দেখা যায় নাই। তবে মাকড় বা ছত্রাকের কারণে কখনো কখনো পাতা কুচকে যেতে দেখা যায়। তখন মালিককে দেখালে তার পরামর্শ অনুযায়ী কীটনাশক দিই। তবে সেটি খুবই কম। এ ছাড়া তেমন অতিরিক্ত সার বা কীটনাশক দেওয়া হয় না। এবার গাছে ফল অনেক আসছে। ডালে ডালে থোকায় থোকায় ধরে আছে। এবারে অনেক লাভ হবে।
তুহিনের মাল্টা বাগান দেখতে আসা স্থানীয় চাষি আব্দুর রহিম বলেন, ‘এ চরেই প্রতি বছর পেঁয়াজ আবাদ করি। দূর থেকে দেখি আর শুনি, চরের এই মাটিতে ভালো মাল্টার আবাদ হইছে। তাই ভাবলাম দেখে আসি। এসে দেখছি মাল্টা ভালোই আসছে গাছে। ২৫০০-২৬০০ টাকা মণ দাম হলে ভালো লাভ হওয়ার কথা। ভাবছি এসবের আবাদই ধরা যায় কি না।
চাষি হানিফ, সবুজ ও রশিদ বলেন, ‘মুড়িকাটা পেঁয়াজ আবাদ করে আমরা ঋণের ভারে একবারে শেষ। দু’এক বছর ছাড়া প্রায় প্রতি বছরই এমন হয়। গত বছরও বিঘা জমিতে অনেকে ৬০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্তও মার খেয়েছে। তবুও আবার মৌসুম এলেই আবাদ করি। আমরা চাষাবাদ ছাড়া করবো কী। তবে মাল্টা চাষে তুহিন ভাই ভালোই লাভ করতেছেন। বছরে লাখ দশেক টাকা লাভ আমাদের জন্য অনেক। লাভ হলে আমরাও এই বাগানই করবো।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক বলেন, ‘মাল্টার ক্ষেত্রে পূর্বে আমদানি নির্ভরতাই বেশি ছিল। এখন চরাঞ্চলে এর চাষ আরও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে। ফলটি বেশ সুমিষ্ট হওয়ায় বাজারেও এর চাহিদা আছে। পাবনায় ১৯ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। আবাদ বৃদ্ধি ও ভালো ফলনের ব্যাপারে কৃষি বিভাগ সহায়তা দিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে তারা ভালো দাম থেকে বঞ্চিত হতেন। তারা ফল সংগ্রহের সঠিক সময় জানতেন না। ফলে আগে আগে সংগ্রহ করায় ওজন ও স্বাদ কম হওয়ায় চাহিদা কম হতো। এখন সমস্যাটি নেই। আমরা প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা দিচ্ছি। কেউ আগ্রহী হলে তাদেরও সহায়তা করবো। আশা করি মাল্টার চাষ আরও বাড়বে।