গীবত বলা ও শোনা সমান পাপ
গীবত শব্দের আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা, পরচর্চা করা, দোষারোপ করা, কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ। হাদিসের বর্ণনায় রয়েছে, “যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ।” (মুসলিম)।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।…অবশ্যই তারা হুতামাতে (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে, দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।”(সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত: ১-৯)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন।’ তিনি বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবত।’
সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর তুহমত ও বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছ।’ (মুসলিম)।
পাঠক, উপরের আলোচনায় নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন গিবত একটি ভয়ানক পাপ। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মানুষ ৭টি বিষয়ের উপর বেশি গীবত করে থাকেন। সেগুলো নিচে দেওয়া হল…
খাবারের গীবত
নিকৃষ্টতম গীবত হল খাবারের গীবত করা। একজন মানুষ কষ্ট করে রান্না করে, আর সবাই মিলে রান্নার বদনাম করতে থাকে। খাবারের গীবত বেশি হয় বিয়ে বাড়িতে। যেমন বলা, খাবারটা মজা হয় নাই, লবণ কম হয়েছে, এত লবণ দিয়েছে যে তিতা লাগছে ইত্যাদি। রাসূল (স.) কখনই খাবারের দোষ ধরতেন না। ভালো না লাগলে এক পাশে সরিয়ে রাখতেন। কখনই বলতেন না, কী খাবার রান্না করেছে মুখেই দেয়া যাচ্ছে না!
দৈহিক কাঠামোর গীবত
কারো কাছে কোন ব্যক্তির দৈহিক ত্রুটি উল্লেখ করাও গীবত। যেমন বলা অমুক ব্যক্তি খুব মোটা, তার নাক বোঁচা, চোখ খুবই ছোট, চোখে দেখে না, মাথায় তো চুল নাই, পেটে ভূড়ি আছে, সে তো খুবই খাট ইত্যাদি। কোন ব্যক্তির আড়ালে অন্য কারো সাথে যদি আপনি ঐ ব্যক্তির দৈহিক কাঠামো নিয়ে এরকম আলোচনা করেন তাহলে তা গীবত হয়ে যাবে। “একবার আয়েশা (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কী সাফিয়ার বেঁটে হওয়াটা অপছন্দ করেন না ? রাসূল (স.) বললেন,”হে আয়েশা! তুমি এমন একটি কথা বললে যা নদীর পানির সাথে মিশিয়ে দিলে তার উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।”
(আবু দাউদ )
পোশাকের গীবত
এভাবে বলা অমুকের পোশাক খাট, কেমন কালারের জামা-কাপড় পরে দেখতে বিশ্রি লাগে, ঐ মেয়ে এত ফিটিংওয়ালা পোশাক পরে, অমুক তো পাতলা ড্রেস পরে ইত্যাদি। “একবার আয়েশা (রা.) বলেন, অমুক স্ত্রীলোকের আচল খুব লম্বা। রাসূল (স.) একথা শুনে বললেন, “হে আয়েশা! তোমার থুথু ফেলা কর্তব্য।” আয়েশা (রা.) বলেন, আমি থুথু ফেললে মুখ থেকে গোশতের একটি টুকরা বের হয়ে আসে। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব)
অভ্যাস বা আচার-আচারণের গীবত
কোন ব্যক্তির আচার ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা করা। যেমন, সে মানুষকে কষ্ট দিয়ে কথা বলে, ব্যবহার খারাপ, অভদ্র, পেটুক, অলস, সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমায় ইত্যাদি। একবার সালমান ফারসী (রা.) আহার করে শুয়ে পড়লেন । দু’ ব্যক্তি তার খাওয়া ও শোয়ার ধরণ নিয়ে সমালোচনা করলে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়। “তোমরা পরস্পরের গীবত কর না।” (সুরা হুজরাত : ১১)
বংশের গীবত
তুচ্ছ করার জন্য কাউকে বলা, অমুকের বংশ নিচু, অমুকের পূর্ব পুরুষেরা ছিল কূলি, মজুর বা চোর, ডাকাত ইত্যাদি, অমুকের তো কোন বংশই নেই ইত্যাদি বলা। রাসূল (স.) বলেন, “দীনদ্বারি ও সৎকর্ম ব্যতীত কোন ব্যক্তির অপর কোন ব্যক্তির উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই ।” (আব্দুর রহমান আশ-শারানী)
ইবাদতের গীবত
ইবাদতের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে সমালোচনা করা। যেমন কাউকে গিয়ে বলা; অমুকতো ঠিকমত নামায পরতে পারে না, মাকরুহ ওয়াক্তে নামায পরে, রমযানের রোজা ঠিকমত রাখে না, এত বড় হয়েছে কিন্তু এখনো নামায পড়ে না, এত বড় মেয়ে কুরআন পড়তে জানে না ইত্যাদি। একবার তাহাজ্জুদের ওয়াক্তে কতক লোক ঘুমিয়ে থাকলে শেখ সা’দী (রহ.) তাদের সমালোচনা করেন এবং বলেন, এই লোকগুলো যদি তাহাজ্জুদ পড়তো তবে কতই না ভালো হত। সা’দীর পিতা একথা শুনে বলেন, কতই না ভালো হত যদি তুমি তাহাজ্জুদ না পড়ে এদের মত ঘুমিয়ে থাকতে। তাহলে এদের গীবত করার
পাপ তোমার ঘাড়ে চাপত না।” (এহইয়াই উলূমিদ-দীন)
কানের গীবত
নিজে না বললেও কারো গীবত শোনা এবং শোনার সময় কোনরুপ বাধা না দেয়া কানের গীবত।
গীবত দু’ভাবে হয়…
১. মুখে বলে
২. কানে শোনে
গীবত বলা ও শোনা সমান পাপ। “রাসূল (স.) বলেছেন, গীবত শ্রবণকারীও গীবতকারীদের একজন।” (তাবরানী)
আল্লাহ তা’আলা আমাদের এই গীবত চর্চা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।