আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় নবী হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-কে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করলেন। তিনি আদেশ দিলেন, যেন ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর প্রিয় স্ত্রী হযরত হাজেরা (আঃ) এবং ছোট শিশু হযরত ইসমাঈল (আঃ)-কে নিয়ে মক্কার জনবিহীন মরুপ্রান্তরে রেখে আসেন।
সেই সময় মক্কা ছিল সম্পূর্ণ নির্জন। সেখানে ছিল না কোনো মানুষ, না কোনো গাছ, আর না কোনো পানির উৎস। চারদিকে শুধু পাথর আর বালুর পাহাড়।
আল্লাহর হুকুমের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত হয়ে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) তাঁদের সেখানে রেখে ফিরে এলেন।
অসহায়ত্ব ও ভরসা
হযরত হাজেরা (আঃ)-এর কাছে ছিল মাত্র অল্প কিছু পানি আর সামান্য খাবার। কিছুদিন পর সেই সামান্য খাবার ও পানি সব শেষ হয়ে গেল। ছোট শিশু ইসমাঈল (আঃ) তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কাঁদতে লাগলেন। সন্তানের এই কষ্ট দেখে মায়ের বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো, কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না।
মায়ের হৃদয়ে তখন একটিই চিন্তা: কোথাও যদি একটু পানি পেতাম!
ভরসা শুধু আল্লাহ্র ওপর রেখে তিনি দৌড়ে গেলেন সাফা পাহাড়ে। চারদিকে তাকালেন, কিন্তু জনমানব বা পানির কোনো চিহ্ন নেই। এরপর তিনি মারওয়া পাহাড়ে গেলেন। সেখানেও নিঃশব্দ মরুভূমি ছাড়া কিছু পেলেন না।
সাতবার দৌড়
এইভাবে তিনি সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌঁড়ালেন। প্রতিটি দৌঁড়ের সময় তাঁর মনে আশা ছিল—কোথাও হয়তো পানি বা কোনো পথিক পাবেন। তিনি ছিলেন ক্লান্ত, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে ছিল আল্লাহর প্রতি অটল ভরসা।
যখন তিনি সপ্তমবার দৌঁড়ে শেষ করলেন, ঠিক তখনই তিনি দূর থেকে দেখলেন—তাঁর ছোট শিশু ইসমাঈল (আঃ) পায়ের গোড়ালি দিয়ে মাটি কাটছেন!
জমজমের উৎপত্তি: যখন তিনি চতুর্থবার মারওয়া পাহাড়ে পৌঁছান, তখন ইসমাইল (আ.)-এর পায়ের কাছে বা জিবরাইল (আ.)-এর ইশারায় মাটি ফেটে পানির ধারা বেরিয়ে আসে। এই অলৌকিক পানির ধারাকে রক্ষা করার জন্য হাজেরা (আ.) ‘জমজম’ (থেমে যাও) বলে চিৎকার করেন, এবং সেই থেকে এর নাম হয় ‘জমজম’।
আর সেই স্থান থেকেই হঠাৎ করে কূপের মতো পানি প্রবল বেগে বের হতে শুরু করলো।
হযরত হাজেরা (আঃ) দ্রুত দৌড়ে সেখানে গেলেন এবং চিৎকার করে বললেন: “জমজম! জমজম!” অর্থাৎ, “থেমে যাও! থেমে যাও!” কারণ, পানি এত দ্রুত বের হচ্ছিল যে, তা চারদিকে ছড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি দ্রুত হাতে বালু দিয়ে চারপাশ ঘিরে পানি জমিয়ে রাখলেন।
জমজমের বরকত
আর এইভাবে, আল্লাহর হুকুমে সৃষ্টি হলো জমজম কূপ—যা আজও পবিত্র মক্কায় প্রবহমান। এই অলৌকিক পানি পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র পানি হিসেবে গণ্য।
নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করেছেন: “জমজমের পানি যে উদ্দেশ্যে পান করা হয়, আল্লাহ সেই উদ্দেশ্য পূরণ করেন।” (ইবনে মাযা)
সুবহানাল্লাহ! যে ভূমি একদিন ছিল নির্জন, আল্লাহ তাতে এমন বরকত দিয়েছেন যে, আজ তা পৃথিবীর হৃদয়ের স্থানে পরিণত হয়েছে। মক্কা মুকাররমা, যেখানে কোটি কোটি মানুষ হজ ও ওমরাহ করতে আসেন এবং জমজমের পানি পান করে নিজেদের নিয়ত পূর্ণ করেন।
আল্লাহর কুদরত: এই ঘটনা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ রহমত ও কুদরত, যা প্রমাণ করে যে তিনি তাঁর অনুগত বান্দাদের কখনো একা ছাড়েন না। এই কূপটি আজও সচল এবং এর পানি অগণিত মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে ও বরকত দিচ্ছে।
শিক্ষা:
আল্লাহর নির্দেশে ত্যাগ স্বীকার এবং আল্লাহর ওপর অটল ভরসা রাখলে, আল্লাহ্ এমনভাবে সাহায্য করেন, যা মানব কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। ধৈর্য, ত্যাগ এবং ইবাদতের মাধ্যমেই জীবনে আল্লাহর বরকত নেমে আসে।