সালমান শাহ: তিন দশক পর চাঞ্চল্যকর মৃত্যুর সলুক সন্ধান

দীর্ঘ ২৯ বছর পর অভিনেতা সালমান শাহর অপমৃত্যু মামলাটি রূপ নিল হত্যা মামলায়। একে একে সামনে আসছে অভিনেতার হত্যায় জড়িত অভিযুক্ত অপরাধীদের নাম। সালমান বাংলা সিনেমার আকাশে জ্বলজ্বল করা এক নাম। সংক্ষিপ্ত সময়ের ক্যারিয়ারে এতবেশি ছাপ রাখতে পেরেছেন আমাদের চলচ্চিত্রে এমন দ্বিতীয়টি কেউ আর নেই। তিন দশক পরও দর্শক-ভক্তদের হাহাকার সেই কথাই যেন বারবার মনে করিয়ে দেয়।
সালমান শাহর চলে যাওয়াটা আজও যেন এক অমীমাংসিত অধ্যায়। অনেকের হৃদয়ে আজও প্রশ্নটা কাঁটার মতো বিঁধে আছে—এটা কি কেবলই আত্মহত্যা ছিল? চার বছরে সাতাশটি ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দিয়ে যিনি কোটি মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছিলেন, তিনি কি সত্যিই নিজের জীবন কেড়ে নিতে পারেন? এই ভাবনাটা কেবল ভক্তদেরই নয়, পুরো দেশবাসীকেই স্তব্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সালমান শাহ এসেছিলেন সম্ভাবনার এক ঝড় হয়ে। নব্বইয়ের দশকে যখন সিনেমার মানে ছিল একই গল্প, একই মুখ, একই সংলাপ, তখন তিনি যেন এক নতুন ঝড়ের আবির্ভাব। তার স্টাইল, তার কথা বলার ধরণ, তার আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি—সবকিছুতেই ছিল এক ভিন্নতা। এই ‘ভিন্নতা’ই ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এটিই হয়তো তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এক অদৃশ্য চক্রান্তের জন্ম দিয়েছিল। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম প্রতিভাবান, জনপ্রিয়, সফল এই অভিনেতার সিনেম্যাটিক এই প্রয়াণ তাই আজও আলোচনার বিষয়।
চলচ্চিত্র জগতের অনেকেই তাকে পছন্দ করতেন না। কারণ, তিনি মেধা, প্রজ্ঞা, দেখতে সুদর্শন হওয়ায় অন্য তারকাদের হিংসার কারণ হয়েছিলেন।
সাফল্যের সিঁড়ি তার যত দ্রুত উপরে উঠেছে, ততই যেন বেড়েছে তার শত্রুদের তালিকা। খ্যাতি তাকে মানুষের ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলেও, একই সঙ্গে তাকে ঘিরে ধরেছিল হিংসা, ঈর্ষা আর এক অজানা রাজনীতির কুয়াশা।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের সেই সকালটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাদময় সকাল। সালমান শাহের অবিশ্বাস্য মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই যেন পুরো দেশ থমকে গিয়েছিল। কেউ ফিসফিস করে বলল আত্মহত্যা, কেউ দাবি করল খুন, আবার কেউ কেউ একে বলল এক সাজানো নাটক। কিন্তু সেই আসল সত্যটা আজও অন্ধকারে ঝুলে আছে।
উনত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে সেই শোকের সকাল থেকে। সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়েছে, নতুন প্রজন্ম এসেছে, কিন্তু সালমান শাহ আজও বেঁচে আছেন পর্দার ওপারে। তার হাসি, তার মায়াবী চোখ, তার প্রতিটি সংলাপ আজও মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। অবশেষে, এত দীর্ঘ অপেক্ষার পর, সেই রহস্যময় মৃত্যুর সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি করা হচ্ছে। হয়তো এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে দেরীতে হলেও, সবচেয়ে প্রত্যাশিত বিচারগুলোর মধ্যে একটি হতে যাচ্ছে।
প্রশ্নটা আজও রয়ে গেছে—কে বা কারা চায়নি সালমান শাহ বেঁচে থাকুক?
সালমান শাহ কেবল একজন অভিনেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। তিনি ছিলেন এমন এক প্রজন্মের কণ্ঠস্বর, যারা স্বপ্ন দেখত, নিজেদের মতো করে বাঁচতে চাইত। তাই তার মৃত্যু কেবল একটি ব্যক্তিগত শোক ছিল না, এটি যেন ছিল তারুণ্যনির্ভর এক জাতির অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতিচ্ছবি।
আজ, যখন তার মৃত্যুর ২৯ বছর পরেও মানুষ ন্যায়বিচার চায়, তখন এটা স্পষ্ট বোঝা যায়—সালমান শাহ নামের এই উজ্জ্বল আলোটি আজও নিভে যায়নি। হয়তো একদিন সেই আলোর তেজে অন্ধকারের আসল খলনায়কদের মুখগুলোও জনসম্মুখে চলে আসবে।














