বিপিএল: সামনে চ্যালেঞ্জের পাহাড়


ফ্র্যাঞ্চাইজি খোঁজার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বৈঠক-সভা চলছে। নানা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। কিন্তু আসলেই কি ডিসেম্বরে বিপিএল শুরু করা সম্ভব? বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইফতেখার রহমান স্বয়ং বলছেন, কাজটা অসম্ভরের কাছাকাছি। তবে এই প্রতিজ্ঞাও তিনি জানিয়ে রাখছেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে চেষ্টার কমতি থাকবে না তাদের।
বিসিবি নির্বাচনের পর প্রথম বোর্ড সভা শেষে এই ইফতেখারই জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত বিপিএল করতে চান তারা। সেই হিসেবে সময় আছে আর স্রেফ মাস দুয়েক।
টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রক্রিয়া মাত্র শুরু হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ হিসাবে দল নিতে এক্সপ্রেস অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) আহ্বান দেওয়া হয়েছে—অর্থাৎ, আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিতে আবেদন করতে বলা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হবে ২৮ অক্টোবর। তারপর চলবে আবেদন পরখ করা, আর্থিক সক্ষমতা ও মালিকানার বৈধতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। এই ধাপ শেষ না হলে কোনো কিছুই পরবর্তী ধাপে এগোবে না।
এখানেই বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেনে বিসিবির সাবেক সভাপতি ও নতুন বোর্ডের পরিচালক ফারুক আহমেদ। গত বছর তাড়াহুড়ো করে বিপিএল আয়োজন করতে গিয়ে ভজকট পাকানো দায় অনেকটাই পড়েছে তার ওপর। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেছেন, ‘‘(গত বছর) রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বেশির ভাগ ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ব্যবসায়ীরা টাকা দিতে চাচ্ছিল না। নতুন স্বাধীন দেশ। সেপ্টেম্বরে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। ফ্রাঞ্চাইজি পছন্দের জন্য অতটা সুযোগ ছিল না। এবারের বিপিএলটা আমার মনে হয়, দেরি হয়ে গেছে। নির্বাচন বলেন আর যে কারণেই হোক। আমি আশা করব, যদি কম দলও হয়… যারা সলিড ফ্রাঞ্চাইজি, আর্থিক সামর্থ্য ভালো আছে, ক্রিকেট নিয়ে যারা চিন্তা করে, লম্বা সময় নিয়ে ফ্রাঞ্চাইজি হিসাবে দাঁড় করাতে চায়, ওইসব ফ্রাঞ্চাইজি আসলে আমার মনে হয় ভালো হয়। ’’
ফারুক বলেন, “লম্বা মেয়াদের চুক্তি দিলে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকরাও ভাবতে পারবেন দলটা কীভাবে স্থায়ীভাবে গড়ে তোলা যায়। সেই দিক থেকে আমি আশাবাদী, বিসিবি এবারও চেষ্টা করবে বিপিএলটা ভালোভাবে আয়োজন করতে। তবে সময়টা কিন্তু দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে (হাসি…)। অনেক কাজ বাকি। ইওআই আপলোড করতে হবে, আগ্রহ দেখতে হবে, বিদেশি ক্রিকেটাররা কোন দলে খেলবে, তা জানতে চাইবে। এগুলোর সঙ্গে অনেক দিক জড়িত। বোর্ড চেষ্টা করছে সব গুছিয়ে আনতে, কিন্তু সময় সত্যিই খুব কম।’’
সবশেষ বিপিএল আয়োজন করে ফারুক যেমন বিপিএলের অসঙ্গতির সঙ্গে কাজের চাপের উত্তাপ টের পেয়েছেন, এবার নতুন বোর্ডে এই আয়োজন নিয়ে একইরকম আঁচ অনুভব করছেন বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইফতেখার।
তিনি বলেন, “এবার যারা ফ্র্যাঞ্চাইজি নেবে, তাদের চুক্তি হবে পাঁচ বছরের জন্য। পরের বছর কেউ যুক্ত হলে, তাদের মেয়াদ এক বছর কমে যাবে। যত দেরিতে কেউ আসবে, তত কম সময়ের জন্য সুযোগ পাবে। প্রতিবার এমন হবে না, এবারের মতো সুযোগ বারবার আসবে না। আগামী বছর আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেব, ব্যবস্থা হবে আইপিএলের মতো। পাঁচ বছরের চুক্তির মধ্যে দল বদল, ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিবর্তন, সবকিছুই আইপিএলের ধাঁচে সাজানো হবে। তবে এগুলো এখনো সিদ্ধান্তের পর্যায়ে আছে।”
“এ মুহূর্তে আমাদের হাতে যে উইন্ডো আছে, তাতে পাঁচটা দল হলে সবচেয়ে স্বস্তিকর, ছয়টা হলেও ম্যানেজ করা যাবে। কিন্তু আইএল টি–টোয়েন্টি আছে, বিদেশি খেলোয়াড় পাওয়া নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে, সময়টাও খুব টাইট। আসলে কিন্তু ‘নেক্সট টু ইমপসিবল’—আমরাও জানি, ফারুক ভাইও বলেছেন ‘নেক্সট টু ইমপসিবল’। খুবই কঠিন। তারপরও আমরা চেষ্টা করে দেখব।”
আগামী বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় শুরু হবে টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। জাতীয় দলকে প্রস্তুতির সুযোগ দিতে বিসিবি চায় এর আগেই বিপিএল শেষ করতে। পুরো আয়োজনের সময়সীমা তাই এবার অনেক কম। এই সঙ্কুচিত সময়েই টুর্নামেন্ট সাজানোর পরিকল্পনা করছে নতুন গভর্নিং কাউন্সিল। পাঁচ থেকে ছয়টি দল নিয়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন করার ভাবনায় নতুন দলের পাশাপাশি পুরোনো, অভিজ্ঞ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকেও ফিরে আসার আহ্বান জানানো হচ্ছে বলে জানান বিসিবির এই পরিচালক।
“বরিশালসহ বড় বড় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। সবাইকে বলা হয়েছে আসতে। আরও চার–পাঁচ দিন পর বোঝা যাবে কারা আসছে, তারপরই পরের কাজগুলো এগোবে।”
উপযুক্ত ফ্র্যাঞ্চাইজি পাওয়া বা না পাওয়ার সমীকরণ তো আছেই। কিন্তু বিপিএল আয়োজনে চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ নয়। নানা চুক্তি ও প্রশাসনিক প্রস্তুতি, বিপণন, স্পনসর ও সম্প্রচার অধিকার, ক্রিকেটারদের বাজার ও ড্রাফটের জটিলতা, মাঠ প্রস্তুতি, সরঞ্জাম ও লজিস্টিকস, খেলোয়াড় নিরাপত্তা ও হোটেল ব্যবস্থাপনা অনেক কিছুই আছে বাকি। সব স্তরে কাজের সমন্বয় না হলে, আগের মতো বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়া একদম অবধারিত।
*ব্যবস্থাপনা ও চুক্তির জটিলতা
ফ্র্যাঞ্চাইজি নির্ধারণের পর যে চুক্তি ও আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে, সেটাই এখন অন্যতম বড় কাজ। বিসিবি, ফ্র্যাঞ্চাইজি ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল—তিন পক্ষেরই আনুষ্ঠানিক সই-সমঝোতা বাকি। বোর্ড এবার মার্কিন ক্রীড়া ব্যবস্থাপনার ধাঁচে কিছু পরিবর্তন আনতে চায়, কিন্তু সেই পরিকল্পনা এখনো ‘কথার স্তরে’। চুক্তির নির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানানো হয়নি। তার ওপর আর্থিক সম্মতি, গ্যারান্টি মানি—এসব প্রক্রিয়া শেষ করতে অন্তত কয়েক সপ্তাহ লাগার কথা। আর সময় যত যাবে, বাকি ধাপগুলোও ততই চাপের মুখে পড়বে।
*বিপণন, স্পনসর ও সম্প্রচার স্বত্ব
বিপিএলের অর্থনৈতিক কাঠামো এখনো ঝুলে আছে। বিপণন ও সম্প্রচার অধিকার বণ্টন নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। স্পন্সরশিপ, ব্রডকাস্ট পার্টনার, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম—সবকিছুই আলোচনা পর্যায়ে। প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের। আগের আসরগুলোতেও সম্প্রচার স্বত্ব দেরিতে চূড়ান্ত হওয়ায় আয়োজনে তা প্রভাব পড়েছিল। এবারও সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
*বিদেশি ক্রিকেটার ও ড্রাফটের জটিলতা
প্লেয়ার্স ড্রাফট আয়োজনের আগে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। কিন্তু সময়ের এই ঘাটতিতে বড় নামের ক্রিকেটার পাওয়া অনেকটাই ভাগ্যের বিষয়। একই সময়ে আরও চারটি লিগ হচ্ছে এবার- বিগ ব্যাশ (১৪ ডিসেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারি), লঙ্কান প্রিমিয়ার লিগ (২৭ নভেম্বর–২৩ ডিসেম্বর), আইএল টি–টোয়েন্টি (২ ডিসেম্বর–৪ জানুয়ারি) এবং এসএ টোয়েন্টি (২৬ ডিসেম্বর–২৫ জানুয়ারি)।
ভালো মানের ক্রিকেটারদের আগ্রহ আইএল টি-টোয়েন্টি ও এসএ টোয়েন্টিতেই বেশি। সেখানে অনেক ক্রিকেটার চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছেন আগেই। লঙ্কান লিগের কারণে এবার শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদেরও পাওয়া যাবে না বিপিএলে। সম্পতি পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের বিদেশি লিগে খেলার অনুমতিও বাতিল করেছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বিপিএল হলে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হবে মানসম্পন্ন বিদেশি ক্রিকেটার আনা।
*মাঠ, সরঞ্জাম ও লজিস্টিক চাপ
বিপিএলের মাঠ ও অবকাঠামো প্রস্তুত করা নিজেই একটা পূর্ণাঙ্গ প্রকল্প। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটের বাইরে যদি রাজশাহী বা খুলনা নতুন ভেন্যু হিসেবে যুক্ত হয়, সেখানেও নতুন করে ক্যামেরা প্ল্যাটফর্ম, ফ্লাডলাইট, মিডিয়া সুবিধা, সব তৈরি করতে হবে। যেসব ভেন্যুতে আলো যথেষ্ট নয়, সেখানকার ম্যাচগুলো দিনে আয়োজনের ভাবনা আছে। দুই দিনে সর্বোচ্চ চারটি ম্যাচ খেলাতে হলে সূচি তৈরি থেকে সম্প্রচার—সবখানেই বাড়বে চাপ।
*খেলোয়াড় নিরাপত্তা ও হোটেল ব্যবস্থাপনা
বিদেশি খেলোয়াড় থাকা মানেই বাড়বে নিরাপত্তার চাপ। প্রতিটি দল, কোচিং স্টাফ, টেকনিক্যাল ইউনিটসহ শতাধিক বিদেশি ক্রিকেটার ও কর্মকর্তা, সবাইকে আন্তর্জাতিক মানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিরাপত্তা সংস্থা, গোয়েন্দা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন, সব পক্ষের অনুমোদন ও তদারকি দরকার হবে আগেভাগে। নির্বাচন–পূর্ববর্তী সময় হওয়ায় সরকার ও বিসিবি উভয়কেই বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে।
*স্থানীয় বড় তারকা অনুপস্থিতি আর বিপণনের ঝুঁকি
বিপিএলের জনপ্রিয়তার বড় স্তম্ভ সবসময়ই বিদেশিদের সঙ্গে স্থানীয় বড় তারকারা। কিন্তু এবার তাদের কয়েকজনের উপস্থিতি নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। রাজনৈতিক কারণে আগের আসরে খেলেননি সাকিব আল হাসান। এবারও তার খেলার বাস্তবতা নেই। ডিসেম্বরে লিগ হলে তামিম ইকবালেরও মাঠে না নামার সম্ভবনাই বেশি। খেলার জন্য প্রস্তত নন তিনি এখনও।
মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহদের আবেদন সময়ের সঙ্গে ক্ষয়ে গেছে অনেকটা। পরের প্রজন্মের অনেকেই খেলবেন। তবে তাদের জনপ্রিয়তা বা তারকাখ্যাতি তো আর ততটা নেই। তারকার দ্যুতি না থাকলে কমে যায় জৌলুস, সেভাবে আকর্ষণ করা যায় না স্পন্সরদেরও।
সবমিলিয়ে এত কম সময়ে বিপিএল আয়োজন করতে হলে এই বোর্ডকে পাড়ি দিতে হবে বাধা আর শঙ্কার পাহাড়।