রাজনীতির চামচা সংস্কৃতি
ক্ষমতার ছায়ায় সুবিধাবাদীর উত্থান


রাজনীতি একসময় ছিল আদর্শ ও আত্মত্যাগের প্রতীক। সেখানে ছিল নেতা মানেই দূরদর্শী, সংগ্রামী ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। কর্মী মানেই আদর্শের ধারক-বাহক, ত্যাগী ও সংগঠনের চালিকাশক্তি। কিন্তু সময় বদলেছে। রাজনীতিতে এখন একটি বিপজ্জনক প্রবণতা বেড়ে চলেছে। তা হলো, চামচা সংস্কৃতি, যেখানে অনুসারীরা নেতার আদর্শ নয়, কেবল ক্ষমতার অনুসরণ করে। এই সংস্কৃতি রাজনীতিকে যেমন কলুষিত করেছে, তেমনি একজন নেতাকেও বারবার বিড়ম্বনায় ফেলেছে।
চামচা সংস্কৃতির মূল চরিত্র হলো সুবিধাবাদ। এই শ্রেণির লোকজন রাজনৈতিক কর্মী নয়, বরং ক্ষমতার ছায়ায় ঘুরপাক খাওয়া সুবিধাভোগী। তারা নেতা বা দলের প্রতি নয়, বরং ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যশীল। এই আনুগত্যও আবার স্থায়ী নয়। যতক্ষণ নেতা ক্ষমতায় থাকেন, ততক্ষণ তাঁকে ঘিরে থাকে; আর যখন নেতার প্রভাব কমে যায়, তখন তারা নিঃশব্দে সরেও যায়, এমনকি প্রতিপক্ষের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
এদের কর্মপদ্ধতিও একেবারে সুপরিচিত—তারা তোষামোদে পারদর্শী, প্রতিপক্ষকে দমন করতে সক্রিয়, এবং নানা অপকর্মে লিপ্ত। চাঁদাবাজি, দখলবাজি, টেন্ডারবাণিজ্য, চাকরি-বাণিজ্য এমনকি নেতা ও দলকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি—সবকিছুই এদের “রাজনৈতিক চর্চা”-র অন্তর্ভুক্ত। নেতার নাম ব্যবহার করে তার চারপাশে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে এরা নিজেদের ক্ষমতাশালী করে তোলে।
এই ধরনের অনুসারীদের জন্য রাজনৈতিক নেতাকে প্রায়শই জবাবদিহিতে পড়তে হয়। জনগণ যখন এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে, তখন তারা নেতা ও কর্মীর পার্থক্য করে না। বরং নেতাকেই দায়ী করে। এতে নেতার জনপ্রিয়তা কমে, দল দুর্বল হয় এবং রাজনীতি থেকে মানুষের আস্থা উঠে যায়।
পক্ষান্তরে, নীতিবান ও আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীরা নেতা ও দলের জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। তারা প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পাশে থাকে, শুদ্ধ রাজনৈতিক চর্চায় বিশ্বাস করে এবং জনসম্পৃক্ত রাজনীতির চর্চা করে। এদের অস্তিত্বই একটি দলের ভিত্তি মজবুত করে। অথচ বাস্তবতা হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেক সময় নিজেই এসব চামচাদের উৎসাহিত করে—তাদের প্রশ্রয় দেয়, পদ-পদবি দেয়, এবং তাদের কথাই বেশি শোনা হয়।
এখানেই তৈরি হয় চরম রাজনৈতিক সংকট। আদর্শিক কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়ে, রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ফলে দল থেকে নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা হারিয়ে যায় এবং রাজনীতি হয়ে পড়ে একদল সুযোগসন্ধানীর আস্তানা।
এই চামচা সংস্কৃতি রাজনৈতিক পরিসরকে শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই করে না, বরং রাজনীতিকে জনবিচ্ছিন্নও করে তোলে। মানুষ রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, বিশ্বাস করে না নেতার ভাষণ, কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে—নেতা যেমনই হোন, তার আশপাশের দুর্নীতিবাজরা ক্ষতি করে চলে দিনরাত।
সুতরাং, সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। একজন রাজনৈতিক নেতা নিজেকে প্রশ্ন করবেন, “আমার আশপাশে যারা আছে, তারা কি আদর্শের অনুসারী, নাকি কেবল সুবিধাবাদী?” দলগুলোও নিজেদের সাংগঠনিকভাবে পর্যালোচনা করবে, “আমরা কীভাবে এমন সংস্কৃতি তৈরি করেছি যেখানে মেধাবী ও ত্যাগীরা পেছনে পড়ে থাকে, আর চাটুকারেরা সামনের সারিতে?”
রাজনীতিকে যদি আমরা আদর্শ ও জনকল্যাণের পথে ফিরিয়ে আনতে চাই, তাহলে এই চামচা সংস্কৃতি ভাঙতেই হবে। নেতাকে হতে হবে বিচক্ষণ, সাহসী এবং আত্মসমালোচনামুখী। দলের ভেতরেই গড়ে তুলতে হবে এমন এক কর্মীবাহিনী, যারা বিশ্বাস করে আদর্শে, এবং দায়িত্ব নেয় জনসেবার।
এটাই হতে পারে একটি শুদ্ধ, গ্রহণযোগ্য ও গণমুখী রাজনীতির সূচনা।