সুলেখা আক্তার শান্তা
অপূরণীয় পূর্ণতা


বড় বোন আবিদা একদিন ছোট ভাই এনামের কাছে এক অনুরোধ নিয়ে আসেন। ভাই, তোর তো দুই সন্তান। একটা সন্তান আমাকে দে।
এনাম কিছু না বললেও, তার স্ত্রী সেলিনা প্রতিবাদ করে ওঠেন। বাবা-মায়ের কাছে কখনো সন্তান বেশি হয় না। আমরা হয়তো ঠিকমতো খাওয়াতে-পড়াতে পারি না, কিন্তু সন্তান কাউকে দিতে পারব না। আমার সন্তান আমার বুকের ধন, আমার কাছেই থাকবে।
আবিদার চোখে জল। তার নিঃসঙ্গ জীবনে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা যেন বুক ফাটিয়ে বেরিয়ে আসে। সেই কান্না দেখে এনামের মন গলে যায়। তিনি বলেন, আমার মেয়েকে আমি আমার বোনকে দেব। ওর কাছে আমার মেয়ে ভালো থাকবে। আমার অভাব-অনটনের সংসারে আমি হয়তো ঠিকভাবে সন্তান মানুষ করতে পারব না। কিন্তু বোনের কাছে থাকলে আমার মেয়ের জীবনটা ভালোভাবে গড়ে উঠবে। ভাই তাঁর বুকের ধন তুলে দিলো বোনের হাতে। ভালোবাসা, ত্যাগ আর বিশ্বাসের এক নিঃশব্দ চুক্তিতে।
সেলিনা চিৎকার করে ওঠেন, তার মানে তুমি আমার মেয়েকে দিতে চাও? এনাম শান্ত গলায় বলেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না সেলিনা। আমার বোনের সন্তানের আফসোস ছিল, আর আমাদের মেয়েটাও আমার বোনের কাছে ভালো জীবন পাবে। আমি শুধু চাই, ও যেন ভালো থাকে।
ভাইয়ের এমন কথা শুনে আবিদার চোখে আনন্দের জল। ভাই, আমি তোকে কথা দিচ্ছি, তোর মেয়েকে আমি কখনো কষ্ট দেবো না। ওকে আমি নিজের সন্তানের মতো মানুষ করব। তোরা দেখবি, আমি কেমন করে ওকে বড় করি। আমার তো কোথাও কোনো কমতি নেই, শুধু ছিল সন্তানের অভাব। তোর মেয়ে শিলা, ওকে পেয়ে আমার সেই অভাব পূর্ণ হবে। সেলিনা চুপ হয়ে যান। তার চোখে জল, কিন্তু মনে এক আশার আলো। তাঁর মেয়ে সুন্দর জীবন পাবে। সেলিনা কাঁপা গলায় বলেন, আপা, আপনি তো চাকরি করেন। মেয়েটা একা পড়ে থাকবে বাসায়। আমার অভাবের সংসার হলেও, মেয়েটা ছিল আমাদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। কাজের মেয়ের কাছে রেখে আপনি অফিসে যাবেন, এতে কি ও ভালো থাকবে?
আবিদা স্নিগ্ধ গলায় উত্তর দেন, সেলিনা, তুমি চিন্তা করো না। তোমার মেয়ের যত্নে কোনো কমতি থাকবে না। আমি ওকে নিজের সন্তানের মতোই মানুষ করব, আমার সবটুকু দিয়ে।
শেষমেশ আবিদা শিলাকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। শিলাকে পেয়ে তাঁর মন ভরে যায় প্রশান্তিতে। শিলার জন্য কী করবেন, সে যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। দিশেহারা হয়ে ওঠেন। শিলার ছোট ছোট হাসি, তার কচি হাতের স্পর্শে আবিদার জীবনে এক নতুন আলো জ্বলে ওঠে।
শিলাকে নিয়ে আসার প্রাই দুই বছর পর, আবিদার গর্ভে সন্তান আসে। এই খবরে আবিদার স্বামী আতিক আবেগে ভরে ওঠেন। শিলা আমাদের ভাগ্যলক্ষী। ও আসার পরেই তোমার গর্ভে সন্তান এলো।
আবিদার চোখে জল, মুখে হাসি। আমি মা হতে পারব! এ যে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ! আমার বড় সন্তান শিলা, ওর ভালোবাসায় কোনো কমতি হবে না। আমার দুই সন্তান, ওরা দুজনেই আমার ঘরে আলো ছড়াবে, আমার জীবনের পূর্ণতা হবে।
আবিদার গর্ভে সন্তান থাকাকালীন হঠাৎ সে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিছানা থেকে উঠতে পারে না, চলাফেরা করাও কঠিন হয়ে যায়। এই সময়ে শিলা যেন ছোট্ট এক পরিপূর্ণ সেবিকা হয়ে ওঠে। মা ঠিকমতো খেলো কিনা, তার কী প্রয়োজন, কখন কী লাগবে, সবকিছুই শিলা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করে। একদিন আবিদা কষ্টের মাঝে মেয়েকে বলেন, মা, তোর কিছু করতে হবে না। তুই তোর পড়ালেখা ঠিকমতো কর। শিলা মায়ের পাশে বসে মৃদু হাসি দিয়ে বলে, মা, আমার পড়ালেখা ঠিকই হচ্ছে। পড়া শেষ করেই তোমার কাছে আসি। তুমি এখন অসুস্থ, তোমার দিকে খেয়াল রাখা আমারই দায়িত্ব। আবিদার চোখে জল নিয়ে মেয়েকে আদর করে বলেন, আমার মেয়ে বলে কী! পাকনা মা আমার!
শিলার ভালোবাসা, যত্ন আর দায়িত্ববোধে আবিদার অসুস্থ শরীরেও যেন এক নতুন শক্তি জেগে ওঠে। এই মেয়ে শুধু তাঁর দত্তক নয়, সে যেন তাঁর হৃদয়েরই অংশ।
সেলিনা হঠাৎ একদিন ঢাকায় আসেন, মেয়েকে দেখতে। বাড়িতে ঢুকেই দেখেন, শিলা ঘরের কাজ করছে। দৃশ্যটা দেখে তার চোখ রাঙা হয়ে ওঠে। কী! আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে? আমার মেয়ে কি কাজের মেয়ে? তিনি রেগে গিয়ে বলেন, আমি আর আমার মেয়েকে এখানে রাখবো না। এখনই নিয়ে যাব।
আবিদা অবাক হয়ে বলেন, সেলিনা, আমার কাছে আসো। কী হয়েছে বলো? সেলিনা ক্ষোভে ফেটে পড়েন, কী আর বলবো! এইটুকু মেয়েকে দিয়ে আপনি কাজ করাচ্ছেন! সেলিনা রাগ করো কেন? আমার ঘরে তো কাজের লোক আছে! মেয়েকে দিয়ে কখনো কাজ করাই নেই। আপনার সংসার সামলাতে আমার মেয়েকে এনেছেন?
আবিদা শান্ত গলায় বলেন, সেলিনা, শিলা কাজ করছে নিজের ইচ্ছায়। আমি কখনো ওকে জোর করিনি। ও আমাকে ভালোবাসে, আমার অসুস্থতার সময় কাজ করছে। সেলিনা কিছু সময় চুপ থাকেন। তারপর বলেন, আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করান, মেয়ে এখানে রাখব না। আবিদা বলেন, তুমি বারবার বলছো আমার মেয়ে, আমার মেয়ে। শিলা কি আমার মেয়ে নয়? হ্যাঁ, পেটের মেয়ে নয়, এটা বলছো ঠিক। কিন্তু ওরে আমি ভাবি না ও আমার পেটের মেয়ে না। এই কথায় সেলিনার চোখে জল আসে। সে বুঝতে পারে, শিলা শুধু তাঁর নয়, শিলা এখন দুই মায়ের ভালোবাসায় বড় হচ্ছে। সেলিনা রাগে ফুঁসে ওঠেন, শিলা আপনের ভাইয়ের মেয়ে! মেয়ে ভাবলে কি মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতেন? আপনের ঘরে কাজের লোক আছে, তারপরও আমার মেয়েকে দিয়ে কাজ করান?
আবিদা কষ্ট পেয়ে বলেন, সেলিনা, তুমি কী বলছো? আমি কখনো শিলাকে ভাবিনি যে ও আমার মেয়ে না। তুমি যা দেখেছো, তা ভুল বোঝাবুঝি। আমি শিলাকে দিয়ে কোনো কাজ করাই না। ওকে আমি কখনো পানি পর্যন্ত ঢেলে খেতে দেই না, বরং আমি নিজে ওর কাজ করে দেই।
সেলিনা রেগে বলেন, আমি আর কিছু শুনবো না। আমি আমার সন্তানকে নিয়ে যাব। সে শিলার দিকে ফিরে বলেন, চল মা, আমার সঙ্গে যাবি। শিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে বলে, আমি মাকে রেখে যাব না। মা অসুস্থ, মা আমাকে ভালোবাসে। আমি এখানেই থাকবো। এই কথায় সেলিনার চোখে জল আসে। সে বুঝতে পারে, শিলা এখন শুধু তার সন্তান নয়, শিলা এখন আবিদারও মেয়ে। একটা সম্পর্ক, যা মায়ার বন্ধন, ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসা কোনো যুক্তিতে বাঁধা পড়ে না।
সেলিনা বলেন, তোর মা কে রে? তোর মা তো আমি! নিজের মাকে রেখে অন্যকে মা বলিস? চল, এখনই আমার সঙ্গে যাবি।
আবিদা তখন এতটাই অসুস্থ যে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। তিনি কাঁপা গলায় বলেন, শিলাকে নিও না… শিলা, মা তুই যাস না…!
শিলা চোখে জল, বলে, আমি মাকে রেখে যাব না। কিন্তু সেলিনা জোর করে শিলাকে টেনে নিয়ে যান। আবিদা বিছানায় শুয়ে কাঁদতে থাকেন, যেন বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।
আতিক স্ত্রীর পাশে বসে বলেন, তুমি অন্যের মেয়ের জন্য এত ভেঙে পড়ছো কেন? শিলা কি তোমার মেয়ে? আবিদা চোখ মুছে বলেন, না, শিলা আমার পেটের মেয়ে নয়। তবে ও আমার হৃদয়। শিলা যদি আমার মেয়ে হতো, তাহলে কেউ ওরে নিয়ে যেতে পারতো না! আতিক চুপ হয়ে যান। আবিদার চোখে শুধু শিলার মুখ ভাসে ওঠে, মেয়ের কথা মনে করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন।
আবিদার ঘরে নতুন আলো আসে। তার গর্ভজাত কন্যা, তুলি। তুলিকে পেয়ে আবিদা যেন জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পান। তবুও শিলার কথা তার মনে পড়ে, প্রতিদিন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, আমার দুই সন্তান। একজন পেটের, একজন হৃদয়ের। শিলা দূরে থাকলেও, তার প্রয়োজনীয় সবকিছু আবিদা পাঠিয়ে দেন। সেলিনা তা গ্রহণ করেন, কিন্তু সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রাখেন।
হঠাৎ একদিন তুলির টাইফয়েড জ্বর হয়! কিছুতেই জ্বর ভালো হয় না। ঘাতক জ্বর তুলিকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। শেষমেশ, তুলি পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। সন্তানহারা মা আবিদা ভেঙে পড়েন। শিলা সিদ্ধান্ত নেয় সে তার মায়ের কাছে ফিরে যাবে। সেলিনা বাধা দিয়ে বলেন, না, তুই যেতে পারবি না।
এনাম দৃঢ়ভাবে বলেন, তুমি কিছুতেই ওকে বাধা দেবে না। ওকে ওর মায়ের কাছে যেতে দাও। শিলা বলে, বাবা, আমি আমার মায়ের কাছে যাব। আজ আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না। এনাম মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, যা মা, তুই তোর মায়ের কাছে যা।
শিলা ছুটে আসে মায়ের কাছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আবিদাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁপা গলায় বলে, মা, তুমি আমার মা। আমি তোমার শিলা। কিন্তু সন্তানহারা আবিদা তখন পাগলের মতো। তাঁর হুশ নেই, কে তুমি? চলে যাও। আমি অপয়া। আমার কোনো সন্তান নেই। আমার সন্তান আমাকে ছেড়ে চলে গেছে…!
শিলার চোখে জল। সে মায়ের পাশে বসে, ধীরে ধীরে সেবা-যত্ন করতে থাকে। দিন যায়, রাত যায় শিলার ভালোবাসা, যত্ন আর ধৈর্যে আবিদা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন।
একদিন আবিদা চোখ মেলে বলেন, আমি পাগল ছিলাম… ভালো ছিলাম… তুমি আমাকে কেন সুস্থ করলে? শিলা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, মা, তুমি যে আমার মা। তোমার সেবা-যত্ন করাই তো আমার কর্তব্য।
আবিদা শিলাকে জড়িয়ে ধরেন। তুলির শূন্যতা, শিলার ভালোবাসায় কিছুটা পূর্ণতা পায়। আবিদা কাঁপা গলায় বলেন, তোমাকে তো তোমার বাবা-মা নিয়ে যাবে মা…!
শিলা জোর গলায় বলে, না মা, আমি আর যাব না। আমি তোমার কাছেই থাকবো। তুমি আমার মা। তোমার কাছ থেকে আমি মা গন্ধ পাই। তুমি আমাকে গর্ভে ধরো না ঠিকই, কিন্তু আমার হৃদয় বলে, তুমি আমার মা। আবিদার চোখে জল আসে। তিনি মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, মা, তুই যাবি না তো? আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না? শিলা আবিদার হাত ধরে বলে, না মা, আমি যাব না। আমি তোমার মেয়ে, চিরকাল তোমারই থাকবো। ঠিক সেই মুহূর্তে এনাম আর সেলিনা এসে দাঁড়ান। দুজনে একসাথে বলেন, আপা, তোমাকে আমরা আমাদের সন্তানকে দিয়ে দিলাম। আর আমরা শিলাকে আমাদের সন্তান বলে দাবি করবো না। তুমি ওর মা, তুমি ওর মা হয়েই থাকো।
আবিদা শিলাকে জড়িয়ে ধরেন। শিলার চোখে আনন্দের জল। আর আবিদার মুখে প্রশান্তির হাসি। আবিদা শিলার সামনে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আমি শিলার মা। আমি শিলার মা হয়েই থাকবো। ও আমার সন্তান ওরে নিয়ে যাবে না তো?
এনাম ও সেলিনা মাথা নাড়েন, না শিলা, তোমার মেয়ে তোমারই মেয়ে থাকবে। আবিদা দুহাত বাড়িয়ে বলেন, আয় মা, আমার বুকে আয়। শিলা ছুটে যায়, জড়িয়ে ধরে তার মাকে। আবিদার বুক যেন প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। হৃদয়ের হাহাকার, সন্তানের শূন্যতা, সব ভুলে যায় তিনি। শিলার স্পর্শে, ভালোবাসায়, তাঁর মন শান্তিতে ভরে ওঠে।
একটা সম্পর্ক, যা জন্ম নয়, ভালোবাসায় গড়ে ওঠে। একটা মেয়ে, প্রমাণ করে, মা হওয়া শুধু রক্তের নয়, হৃদয়েরও।