বিয়েটা কনটেন্ট নাকি কমিটমেন্ট?


বিয়েটা কনটেন্ট নাকি কমিটমেন্ট?
― ইনফ্লুয়েন্সারদের ভিউয়ের জন্য বিয়ে ট্রেন্ডের সামাজিক প্রভাব
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা দৃশ্য খুব সাধারণ হয়ে উঠেছে।
একটা সুন্দর সাজসজ্জা, অভিজাত লোকেশন, হাসিমুখে বর-কনে, আর ব্যাকগ্রাউন্ডে ভাইরাল গান।
দেখে মনে হয়—কারো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
কিন্তু কয়েকদিন পরই ক্যাপশন আসে:
“This was just a content shoot. Not a real wedding.”
অথবা, লাইভে এসে ইনফ্লুয়েন্সার বলছেন—“ভিউয়ের জন্যই করেছিলাম। সত্যিকারের বিয়ে না।”
এই ট্রেন্ড এখন শুধু হাস্যকর নয়, বরং সামাজিকভাবে বিপজ্জনক। কারণ, এটা কেবল বিনোদনের নামে ব্যক্তিগত অনুভূতিকে নয়, সম্পর্ক, প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাস এবং সামাজিক মানসিকতাকেও তুচ্ছ করে দিচ্ছে।
বিয়ে—সদ্য ভাইরাল হওয়া গিমিক নয়, এটা এক সামাজিক চুক্তি।
বিয়ে মানে কেবল সাজসজ্জা, ছবি তোলা বা ভিডিও বানানো নয়।
বিয়ে হলো দুইটি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতির সম্পর্ক।
আমাদের সমাজে বিয়ের গুরুত্ব বহুপ্রজন্ম ধরে তৈরি হয়েছে।
এটা কেবল একটি পারিবারিক উৎসব নয়—একটি সামাজিক, ধর্মীয় এবং মানসিক বন্ধন।
কিন্তু যখন কেউ শুধু ইউটিউব ভিউ বা রিলস ভিউয়ের জন্য “বিয়ে” নামের নাটক করে, তখন তারা সেই সম্পর্কের গাম্ভীর্যকে ছোট করে ফেলে।
এই ট্রেন্ড সমাজে কী বার্তা দিচ্ছে?
১. “বিয়ে মানে বিনোদন”—এই ভুল ধারণা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে
অনেক তরুণ-তরুণী এখন ইনফ্লুয়েন্সারদের দেখে ভাবছে—বিয়েটাও একটা শো!
যেখানে আপনি চাইলে অভিনয় করতে পারেন, চাইলে পরে অস্বীকার করতে পারেন।
এর ফলে বিয়ের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা হারাচ্ছে।
২. বিশ্বাসভঙ্গকে স্বাভাবিক করা হচ্ছে
যখন কেউ বলে, “এইটা আসলে মজার ভিডিও ছিল, সত্যিকারের বিয়ে না”—তখন তারা বুঝতে পারে না যে তাদের ফলোয়ারদের মধ্যে অনেকেই হয়তো সেটা সত্যি ভেবেছিল।
তাদের চোখে আপনি প্রতারণা করছেন।
আর এই মিথ্যা বারবার দেখলে মানুষের মধ্যেও বিশ্বাস হারানোর প্রবণতা তৈরি হয়।
৩. বিয়ের আগেই মানসিক প্রস্তুতি কমে যাচ্ছে
যারা সত্যিকারে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তাদের মধ্যেও একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়—
“সত্যিই কি এটা সিরিয়াস কিছু? নাকি যে কেউ যখন তখন শেষ করে দিতে পারে?”
এই মনোভাব মানসিকভাবে মানুষকে কমিটমেন্ট-ভীতু করে তুলছে।
৪. ফলোয়ারদের ইমোশন নিয়ে খেলা
এগুলো কেবল “ফান কন্টেন্ট” নয়। অনেক ফলোয়ার ইনফ্লুয়েন্সারদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে—ভালোবাসে, অনুপ্রাণিত হয়, তাদের দেখে জীবন গুছাতে চায়।
তাদের চোখে এসব নাটক ভেঙে দেয় বিশ্বাস, এবং এক ধরনের হতাশা তৈরি করে।
তাহলে ইনফ্লুয়েন্সারদের দায় কতটুকু?
ইনফ্লুয়েন্সাররা কেবল “নিজের প্ল্যাটফর্ম” চালাচ্ছেন না—তারা সমাজের বহু তরুণ-তরুণীর রোল মডেল।
তারা যা দেখায়, তা অনেকেই সত্যি ভাবে।
তাই কোনো কিছু “মজার” বা “ভিউ পাওয়ার” অজুহাতে করলে, তার প্রভাব শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ থাকে না—তা সমাজের চিন্তাধারাকে ধ্বংস করে।
কী হতে পারে এর ইতিবাচক বিকল্প?
• সম্পর্ককে শ্রদ্ধা করে এমন কনটেন্ট তৈরি করা
• সত্যিকারের বিয়ের প্রস্তুতি, মানসিকতা, দায়িত্ব ইত্যাদি নিয়ে ভিডিও বানানো
• “ভিউ নয়, ভ্যালু”—এই নীতিতে কনটেন্ট বানানো
• কমিটমেন্টের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলা
বিয়ে কোনো ট্রেন্ড নয়। বিয়ে কোনো ভাইরাল চ্যালেঞ্জ নয়। বিয়ে হলো জীবন গঠনের সূচনা।
ইনফ্লুয়েন্সারদের অনেক বড় প্ল্যাটফর্ম আছে, তাদের দায়িত্বও ততটাই বড়।
তারা যদি “মিথ্যা সম্পর্ক” দেখিয়ে দর্শকের আবেগ নিয়ে খেলেন, তাহলে সেটি কেবল সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষতি নয়—সমগ্র সমাজে একটা ভুল বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
সুতরাং, কনটেন্টের নামে “ভিউয়ের জন্য বিয়ে” এক ধরনের সম্পর্ক বিকৃতি, যা আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
ভিউ শেষ হবে একদিন।
কিন্তু সমাজের ভিত যদি নড়ে যায়, তার দায় আমরা কেউ এড়াতে পারবো না।