জনগণের ইচ্ছায় রাষ্ট্রপতির অর্ডারঃ সাংবিধানিক সংকটের ইঙ্গিত
রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর সাম্প্রতিক একটি “অর্ডার” বা আদেশ জারি দেশের রাজনৈতিক মহলে তীব্র আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিষয়টি শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি বাংলাদেশের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ, রাষ্ট্রের ক্ষমতার কাঠামো এবং জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রয়োগপদ্ধতির ওপর গভীর প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি এর আগে সংবিধানের ৯৩ অনুচ্ছেদের আলোকে অধ্যাদেশ জারি করেছেন, যা একটি স্বীকৃত ও সীমাবদ্ধ ক্ষমতা। কিন্তু এবার তিনি অধ্যাদেশ নয়, বরং “জনগণের পরম অভিপ্রায়ের ক্ষমতাবলে” একটি “অর্ডার” জারি করেছেন, এবং এখানেই পুরো সমস্যার জন্ম।
বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি থাকলেও তার প্রয়োগের একমাত্র বৈধ পথ হলো সংবিধান-সময় পরীক্ষিত প্রতিষ্ঠানসমূহ। রাষ্ট্রপতি জনগণের সরাসরি ম্যান্ডেটধারী নন; তিনি পরোক্ষভাবে নির্বাচিত একটি সাংবিধানিক পদ। তাঁর দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রের কার্যসম্পাদন করা। সংবিধানের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রপতির সর্বোচ্চ ক্ষমতা নির্ধারিত এবং তা অতিক্রম করার কোনো অধিকার তিনি রাখেন না। সে কারণে “জনগণের অভিপ্রায়” নামে একটি আদেশ জারি করা মূলত সংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে একধরনের বিপ্লবী বৈধতা দাবি করার মতো। রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন জনগণ তাঁকে এই বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে, তবে তা সংবিধানের কোথায় এবং কীভাবে নিহিত আছে—তার ব্যাখ্যাও প্রয়োজন।
এখানে সবচেয়ে বড় সাংবিধানিক সংকট হলো একটি “ডুয়াল ক্যারেক্টর” বা দ্বৈত চরিত্রের সৃষ্টি। রাষ্ট্রপতি কি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান, নাকি গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী জনগণের সরাসরি প্রতিনিধি? এই দুই অবস্থান একসঙ্গে বহন করা সম্ভব নয়। সংবিধানিক বৈধতা আসে আইনের বিধান থেকে; বিপ্লবী বৈধতা আসে জনগণের সরাসরি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সৃষ্ট ক্ষমতা থেকে। রাষ্ট্রপতি যদি দ্বিতীয় অবস্থান গ্রহণ করেন, তবে সংবিধান বহাল রেখে তাঁর পদক্ষেপ মূলত সাংবিধানিক কর্তৃত্বকে অকার্যকর করে দেয়। অথচ তিনি সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করেননি, কিংবা বিপ্লবী সরকার গঠনের কোনো প্রক্রিয়াও শুরু করেননি। ফলে একটি সাংঘর্ষিক ও অস্পষ্ট অবস্থার জন্ম হয়েছে।
এই আদেশ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই যে অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, তা এখনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংবিধান যদি সর্বোচ্চ আইন না থাকে, তবে সংসদ কীভাবে আইন প্রণয়ন করবে? প্রশাসন কার আদেশ মানবে—সংসদীয় আইন না রাষ্ট্রপতির “জনগণের অভিপ্রায়” ভিত্তিক আদেশ? বিচার বিভাগ কীভাবে এই আদেশের বৈধতা নির্ধারণ করবে? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতে যখন নির্বাচিত সংসদ গঠিত হবে, তখন রাষ্ট্রপতির এই অর্ডার তাদের চোখে কী বৈধতা পাবে? এমন একটি অবস্থায় নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে বিভিন্ন সময়ে সামরিক শাসন কিংবা একদলীয় ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে “বিপ্লবী আদেশ” বা “বিচ্যুত ক্ষমতা” ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু তখন সংবিধান খোলাখুলিভাবে স্থগিত, সংশোধিত বা সীমিত করা হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি তার থেকে আলাদা এবং আরও জটিল। কারণ সংবিধান কার্যত বহাল, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা উপেক্ষিত; রাষ্ট্রপতি সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও সংবিধানের ঊর্ধ্বে অবস্থান নিচ্ছেন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি সুস্পষ্ট পথ প্রয়োজন। সর্বপ্রথম, রাষ্ট্রপতির এই আদেশের সাংবিধানিকতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের স্পষ্ট ব্যাখ্যা অত্যন্ত জরুরি। কারণ রাষ্ট্রপতি যদি সংবিধানের সীমা ছাড়িয়ে থাকেন, তবে তা বিচার বিভাগের রুলিং ছাড়া কোনোক্রমেই প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, জনগণের অভিপ্রায় যদি সত্যিই পরিবর্তনের দাবি জানায়, তবে তা বাস্তবায়নের পথ সংবিধানসঙ্গত রাজনৈতিক সংলাপ ও নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব কখনো ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হতে পারে না; তা হলে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়ে যায়।
রাষ্ট্রপতির এই আদেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক নতুন ধাপ নয়; বরং একটি নতুন সংকটের সূচনা। এটি দেখিয়ে দিয়েছে, জনগণের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক, এর প্রয়োগ সংবিধান-নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যেই হতে হবে। নইলে রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু অস্থির হয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যতের রাজনৈতিক পথ আরও জটিল হয়ে যায়।











