মোঃ আব্দুল কাদের শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও প্রেসিডেন্ট জিয়া


বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, একদলীয় শাসন এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে স্থবির করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৫-১৯৮১ সাল পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নয়, বরং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারও পথপ্রদর্শক ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী পালাবদলের মধ্য দিয়ে দেশ এক রাজনৈতিক সংকটে পড়ে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান প্রথম দৃশ্যমান নেতৃত্বে আসেন। সে সময় রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের পর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হন এবং জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন—গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়কালে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)’ গঠন করা হয়, যা বহুদলীয় রাজনীতিকে বিলুপ্ত করে দেয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হয়, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়, রাজনৈতিক বিরোধিতা নিষিদ্ধ করা হয়। এই শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের শেষ দিকে একে একে রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেন। তিনি মনে করতেন, গণতন্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি হলো রাজনৈতিক মতের বহুমাত্রিকতা এবং জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।
১৯৭৭ সালের ৩০ মে অনুষ্ঠিত গণভোটে জিয়াউর রহমান ৮৮.৫৭ শতাংশ ভোটে বিজয়ী হন। এ গণভোট ছিল তার জনপ্রিয়তার একটি জনসমর্থিত প্রমাণ এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্তির একটি মাধ্যম। এ সময় থেকেই তিনি জাতীয় ঐক্য গঠনে মনোনিবেশ করেন।
১৯৭৮ সালের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি। সে বছর জিয়াউর রহমান ঘোষণা দেন, প্রতিটি নাগরিক তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠনের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার পাবে।
একই বছর ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮ সালে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’ গঠিত হয়। এই দলই পরবর্তীতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বিএনপির জন্মের মধ্য দিয়ে দেশে পুনরায় একটি শক্তিশালী বিরোধী দল এবং নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হয়, যার ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবাদ, বহুমাত্রিক মতবাদ এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ।
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে শুরু করেন। এ নির্বাচনে দেশের ২৯৯টি আসনে ৪২টি রাজনৈতিক দল ও ১৮৭০ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। এই নির্বাচনকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তুলনামূলক স্বচ্ছ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ২৮৭টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপি জোট ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। এটি ছিল বহুদলীয় অংশগ্রহণে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, যা দেশে গণতান্ত্রিক ধারার পুনর্জাগরণ ঘটায়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও ক্রমশ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত বেশ কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা পুনরায় প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়কার সংস্কারমূলক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’-এর ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা এবং সরকারি প্রচারযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণহীন করার চেষ্টা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
শুধু রাজনৈতিক পরিসরে নয়, গ্রামীণ উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার এবং শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির ক্ষমতায়নেও জিয়াউর রহমানের অবদান গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত করে। তিনি ‘গ্রাম হবে শহর’ এই কর্মসূচি চালু করেন এবং ১৯৭৭ সালে “স্বাধীন পল্লী সরকার” গঠনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক বিকাশে ভূমিকা রাখেন।
উল্লেখযোগ্যভাবে, শহীদ জিয়াউর রহমান জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি পুনঃগঠনে কূটনৈতিকভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস তার সরকারের বৈশ্বিক নীতিতে প্রতিফলিত হয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর একটি অংশের হাতে শহীদ জিয়াউর রহমান নিহত হন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটে, কিন্তু বহুদলীয় গণতন্ত্রের যে ভিত্তি তিনি গড়ে দেন তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির স্থায়ী উপাদানে রূপ নেয়।
পরিশেষে বলা যায়, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় এক ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। তার শাসনামলে গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও সংস্কারসমূহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি একদিকে বহুদলীয় রাজনীতির মুক্ত পথ উন্মুক্ত করেন, অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। গণভোট, দল গঠন, নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনরায় চালু, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক চর্চা—এই সবই বহুদলীয় গণতন্ত্রের সূচনার শক্ত ভিত্তি হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।