মোঃ আব্দুল কাদের ইংরেজি বিভাগ তাড়াশ কলেজ, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ।
বহুমুখী যুদ্ধের মুখোমুখি ভারত: প্রতিবেশী বৈরিতায় পরিণতি


দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে চিহ্নিত। এই অঞ্চলে বহু জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ভাষা ও জাতীয়তাবাদের সহাবস্থান থাকলেও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক বরাবরই দ্বিধান্বিত ও সংঘাতপূর্ণ। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে একসময় এর প্রতিবেশীদের ওপর পরোক্ষ কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, কৌশলগত জোট পুনর্গঠন, অভ্যন্তরীণ সামাজিক মেরুকরণ এবং সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি—সব মিলিয়ে ভারতের জন্য এক আশঙ্কাজনক বাস্তবতার সূচনা ঘটিয়েছে।
বর্তমানে ভারত এমন একটি সম্ভাব্য পরিস্থিতির মুখোমুখি, যেখানে তার চারপাশের প্রায় সব প্রতিবেশী রাষ্ট্র—পাকিস্তান, চীন, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মিয়ানমার—বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতি সন্দেহ ও অসন্তোষ পোষণ করছে। একারণে ভারত এক বহুমুখী যুদ্ধ বা “মাল্টি-ফ্রন্ট ওয়ার” এর আশঙ্কা এখন শুধু সামরিক জল্পনা নয়, বরং কৌশলগত বিশ্লেষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়বস্তু। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতের পরিণতি কেমন হতে পারে, সেই বিষয়েই সম্প্রতি একটি গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। গবেষণাটিতে মূলত তিনটি সম্ভাব্য যুদ্ধ-দৃশ্যপট, তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রের সম্ভাব্য কৌশলগত এবং মানবিক প্রভাব, এবং ভারতের প্রতিরক্ষা কাঠামোর দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রথমতঃ ধরা যাক একটি সীমিত যুদ্ধের সম্ভাবনা। এই ধরনের যুদ্ধ সাধারণত স্বল্পমেয়াদী হয় এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খোঁজা হয়। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা, অথবা বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে পানিবণ্টন ও সীমান্ত নির্ধারণ নিয়ে কোনো সংঘর্ষ যদি সাময়িক আকারে রূপ নেয়, তবে ভারত কিছু ভূখণ্ড বা কূটনৈতিক সুবিধা ছেড়ে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। তবে এমন সমঝোতা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ডেকে আনতে পারে।
দ্বিতীয়তঃ দৃশ্যপটটি আরও উদ্বেগজনক। এটি হলো একটি প্রলম্বিত যুদ্ধ বা পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘর্ষের রূপ। যদি চীন এবং পাকিস্তান একযোগে সামরিক অভিযান চালায়, এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশ, নেপাল কিংবা মিয়ানমার কৌশলগতভাবে ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে একাধিক ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সামরিক সক্ষমতা, যেটি বহুবিধ প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সরঞ্জামের উপর নির্ভরশীল, চরম পরীক্ষার মুখোমুখি হবে। অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ, সংখ্যালঘু নিপীড়নের অভিযোগ, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দ্বিধা—সব মিলিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাও নষ্ট হতে পারে।
তৃতীয়তঃ সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যপটটি হলো পারমাণবিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা। ভারত, পাকিস্তান এবং চীন—তিনটি দেশই পারমাণবিক শক্তিধর। যদি যুদ্ধ এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে কৌশলগত অথবা আত্মরক্ষার দোহাই দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তবে তা কেবল এই তিনটি দেশের জন্য নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি, ব্যাপক পরিবেশগত ধ্বংস, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট—সবই এই এক মাত্র যুদ্ধের সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারত কেন এমন এক দুর্বল অবস্থানে এসে দাঁড়াল? এর উত্তর খুঁজতে গেলে তিনটি স্তর উঠে আসে: কৌশলগত, প্রতিরক্ষা এবং সামাজিক। কৌশলগতভাবে ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আস্থা ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। একদিকে যেমন চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) অঞ্চলজুড়ে প্রভাব বিস্তার করছে, অন্যদিকে ভারত একা একা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করছে। নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা, মিয়ানমারের সঙ্গে নিরাপত্তা বিভ্রান্তি, এবং শ্রীলঙ্কায় চীনের বিনিয়োগ—সবই ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
প্রতিরক্ষা কাঠামোর দিক থেকেও ভারত বহু ফ্রন্টে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। যদিও ভারতের সামরিক বাহিনী বিশাল, তবু আধুনিকায়ন, প্রযুক্তিগত সমন্বয়, এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়ার সক্ষমতা নিয়ে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা শিল্প এখনও অনেকাংশে বিদেশ নির্ভর।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সামাজিক ঐক্যের অভাব। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধর্মীয় মেরুকরণ, রাজনৈতিক মেরুকরণ, সংবাদমাধ্যমের বস্তুনিষ্ঠতার অভাব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য ভারতের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। যুদ্ধের সময় এই ভাঙন আরও প্রকট হতে পারে এবং জাতীয় ঐক্য বিঘ্নিত হতে পারে।
এই ভাবনার আলোকে বলা যায়, ভারত যদি সময় থাকতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন না করে, তার প্রতিরক্ষা কাঠামোকে আধুনিক ও কার্যকর না করে এবং জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করে, তবে সামনে একটি চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে হবে। এমনকি ভারতের দীর্ঘমেয়াদী জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে।
অতএব, ভারতের উচিত এখনই চারটি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করা: প্রথমত, প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিশ্বাসভিত্তিক কূটনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা; দ্বিতীয়ত, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলা; তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও সামাজিক সম্প্রীতি বজায় রাখা; এবং চতুর্থত, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের দিকে দৃঢ় অগ্রসর হওয়া।
বিশ্ব ইতিহাসে বহু শক্তিধর রাষ্ট্রের পতনের পেছনে মূল কারণ ছিল তাদের অভ্যন্তরীণ অদূরদর্শিতা ও বহির্বিশ্বের বাস্তবতা অনুধাবনের ব্যর্থতা। ভারত যদি এই দুই ক্ষেত্রেই নতুন করে চিন্তা না করে, তবে তার পরিণতিও অতীতে ঘটিত সেইসব পরাশক্তির মতোই হতে পারে।
বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে আছে যেখানে যুদ্ধ নয়, কৌশলগত সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক পারস্পরিকতা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের উচিত এই নীতিবোধ সামনে রেখে তার জাতীয় নীতিমালা পুনর্গঠন করা।