বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি অস্বস্তিকর বাস্তবতা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো – রাজনৈতিক নেতাদের মুখ থেকে যা শোনা যায় এবং বাস্তবে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যা দেখা যায়, তার মধ্যে একটি গভীর ও বিস্তর ফারাক তৈরি হয়েছে। বচন ও বাস্তবতা, প্রতিশ্রুতি ও কর্ম, উচ্চকণ্ঠ নৈতিকতা ও দৈনন্দিন আচরণের এই বৈপরীত্য আজ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মুখ্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং গণতান্ত্রিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আবহমান বাংলাদেশের জন্য শ্রবণ ও দর্শনের এই অমিল নাগরিক আস্থা, সুশাসন এবং জাতীয় অগ্রগতির ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভাষণ ও বাগ্মিতা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে শুরু করে উন্নয়ন-উদ্দীপক ঘোষণা পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা দীর্ঘদিন ধরে জনমত গঠনে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। নেতারা গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, ন্যায়বিচার, উন্নয়ন, কল্যাণ ও স্বচ্ছতা নিয়ে আবেগপূর্ণ বক্তৃতা দেন। তাঁদের শব্দ ও উচ্চারণ এক ধরনের শ্রুতিলোক তৈরি করে যেখানে আশা, পরিবর্তন ও সম্ভাবনার প্রতিশ্রুতি গুনগুন করে। কিন্তু এই শ্রুতিলোক যখন বাস্তবতার কঠিন মাটির সঙ্গে সংঘর্ষে আসে, তখন তা প্রায়ই ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। নাগরিকেরা তাঁদের চোখ দিয়ে রাজনৈতিক বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করেন এবং দেখতে পান যে, বলা কথা ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে বিস্তর ফারাক বিরাজ করছে।
এই বৈপরীত্য নতুন কিছু নয়। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটি ধারার জন্ম হয়েছে, যেখানে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রবণতা বাস্তবায়নের চেয়ে অনেক বেশি। নির্বাচনী ইশতেহার প্রায়ই বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন কল্পনাপ্রসূত নথিতে পরিণত হয়। উন্নয়নমূলক ভাষণে যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তার অনেকাংশই বাস্তব কাঠামো বা সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ধরনের বক্তৃতা অধিকাংশ সময়ে জনগণকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে তৈরি হয়, তথ্যভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য নয়। ফলে জনগণের শ্রবণেন্দ্রিয়কে সন্তুষ্ট করতে নেতারা যেসব কথা বলেন, তা জনগণের দর্শনেন্দ্রিয়ের দেখা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য খুঁজে পায় না।
শাসন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই এই অসামঞ্জস্য সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। নাগরিকেরা গণতন্ত্র, সংবিধান ও ন্যায়বিচারের প্রতি নেতাদের অঙ্গীকার শোনেন, কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন লঙ্ঘন, দলীয়করণ ও স্বেচ্ছাচারিতা প্রত্যক্ষ করেন। দুর্নীতি দমনের অঙ্গীকার শোনানো হয়, কিন্তু দেখা যায় জবাবদিহির ঘাটতি। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়, অথচ বাস্তবে দলীয় নিয়োগ, প্রভাবিত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং অনুসন্ধানের অর্ধেক পথেই থেমে যাওয়া নজরে আসে। আইনের শাসন প্রায়ই কথার ফুলঝুরি হিসেবে থেকে যায়, বাস্তব প্রয়োগে দুর্বলতা থেকেই যায়। এই কথামালা ও কাজের অসঙ্গতি নাগরিক আস্থাকে দুর্বল করে তোলে, কারণ জনসাধারণ দেখতে পান, নেতাদের বক্তব্য ও দেশের বাস্তব শাসনচিত্র একে অপরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এই বৈপরীত্য সুস্পষ্ট। নেতারা তাঁদের বক্তৃতা ও বিবৃতিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা, অবকাঠামোগত বিস্তার এবং উন্নয়নকে তুলে ধরেন। এই সাফল্যগুলোর অনেকই সত্য, তবে বক্তৃতায় সাফল্য যতটা উচ্চকিত হয়, জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতা ততটাই ভিন্ন। মানুষ প্রতিদিন বাজারে মূল্যবৃদ্ধি দেখেন, অথচ তাঁরা শোনেন যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাঁরা শোনেন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে, কিন্তু দেশের শিক্ষিত যুবকদের চাকরির জন্য হাহাকার কমে না। তাঁরা শোনেন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল, অথচ তাঁরা সংবাদে রিজার্ভের ওঠানামা ও ঋণ নির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার খবর দেখেন। ফলে বাস্তবতা মানুষের চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তাঁরা উপলব্ধি করেন, অর্থনৈতিক বয়ান অনেক সময়েই সত্যকে আড়াল করে রাখে।
নাগরিক অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এই অমিল আরও তীব্র। রাজনৈতিক নেতারা গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক সহনশীলতার কথা ঘোষণা করেন, কিন্তু নাগরিকেরা দেখেন ভিন্ন বাস্তবতা—বাকস্বাধীনতার ওপর নজরদারি, সমালোচনার ভয়, বিরোধী মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং গণমাধ্যমের ওপর চাপ। সংলাপ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির কথা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে বিরোধী রাজনীতির ওপর বিধিনিষেধ, গ্রেপ্তার এবং ভিন্নমত দমনের ঘটনাই বেশি চোখে পড়ে। ফলে রাজনৈতিক বয়ান আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার আড়ালে থাকে, আর দেশীয় বাস্তবে ক্ষমতা সুসংহত করার রাজনীতি চালু থাকে।
শ্রবণ ও দর্শনের এই অমিলের মানসিক প্রভাবও গভীর। যখন মানুষ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিশ্রুতি শুনতে শুনতে বাস্তবতায় দেখেন তার উল্টো ছবি, তখন তারা রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাতে শুরু করেন। সন্দেহ, হতাশা ও রাজনৈতিক বিমুখতা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট, কারণ তারা তথ্যপ্রযুক্তি-সচেতন, তারা রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে তথ্যের তুলনা করেন এবং দ্রুত বিবেচনা করতে পারেন কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো এই অমিলের মূল কারণগুলি ব্যাখ্যা করে। জবাবদিহির ঘাটতি এমন একটি পরিবেশ তৈরি করে, যেখানে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের চেয়ে বক্তৃতা দেওয়া সহজ হয়ে যায়। পৃষ্ঠপোষকতা-ভিত্তিক রাজনীতি কথাকে বাস্তবতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিশ্চিত করে যে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলি তা প্রায়ই বাস্তবায়নের আগে থেমে যায়।
এই শ্রবণ–দর্শন বৈপরীত্যের গণতান্ত্রিক মূল্য খুবই গুরুতর। যখন জনগণ রাজনৈতিক বক্তব্যে বিশ্বাস হারায়, তখন তারা রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াতেও আস্থা হারায়। প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, জবাবদিহি কমে যায়, এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি বাড়ে। অমিল বেশি হলে তা সামাজিক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
অতএব, বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে এগোতে হলে নেতাদের কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ডের সমন্বয় অপরিহার্য। বক্তৃতা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক; প্রতিটি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে থাকতে হবে তথ্য, সময়রেখা ও বাস্তবায়ন কৌশল। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও শক্তিশালী ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে যাতে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি যাচাই ও বাস্তবায়ন করা যায়। নাগরিক ও গণমাধ্যমেরও উচিত রাজনৈতিক বক্তব্যকে সমালোচনামূলকভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে দেশের প্রয়োজন এমন নেতৃত্ত্ব, যারা কথার সঙ্গে কাজের মিল ঘটাতে সক্ষম। দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে নেতারা কতটা সত্যনিষ্ঠভাবে এই দুই ইন্দ্রিয়—শ্রবণ ও দর্শনের—ফারাক দূর করতে পারেন তার ওপর। কথায় এবং কর্মে সত্য ও দায়িত্বশীলতা প্রতিষ্ঠিত হলেই বাংলাদেশ একটি ন্যায়সঙ্গত, সুশাসিত এবং আস্থাশীল রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে।


মোঃ আব্দুল কাদের সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ তাড়াশ কলেজ, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ