
তিন প্রজন্মের পরীক্ষিত দল বিএনপি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ‘প্রথম প্রজন্ম’। আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘দ্বিতীয় প্রজন্ম’ এবং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘তৃতীয় প্রজন্ম’।
শুরু থেকেই জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী এই বিএনপির পরিচয় ছিল ডানপন্থী রাজনৈতিক দল হিসেবে। বিএনপির ঘনিষ্টতাও ছিল দক্ষিণপন্থী তথা ইসলামপন্থীদের সঙ্গে।
দেশের মানুষ সব সময় প্রত্যাশা করেছে যে, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে ডানপন্থী বিএনপি জোটবদ্ধ থেকেই ভারতপন্থী আর বামপন্থীদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করবে।
সম্প্রতি হঠাৎ করে জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শের সেই তিন প্রজন্মের বিএনপিকে রূপান্তরিত করে নতুন এক পরিচয়ে ‘বামপন্থী বিএনপিকে’ হাজির করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি গতকাল ২৬ জুলাই এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থীদের উত্থানে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা বলে প্রমান করেছেন, তার দল বিএনপি এখন দক্ষিনপন্থার বিরুদ্ধে। অর্থাৎ বিএনপি এখন একটি ‘বামপন্থী’ রাজনৈতিক দল।
প্রথম আলোয় দেওয়া ঐ সাক্ষাতকারের প্রশ্ন ছিলো-‘‘তাহলে কি আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হতে যাচ্ছে ? আপনি কী দেখেন ?’’
এর জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছেন,‘‘আমিও দেখছি। সে জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। সেই জায়গায় যদি এখন এমন এমন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়, যারা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে করে না। আবার তারা নিজেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় মতবাদকে, এটা নি:সন্দেহে এলার্মিং সিচুয়েশন।’’
দক্ষিণপন্থীদের পরিচয় দিতে গিয়ে মির্জা সাহেব বলেন,‘‘কিছু কিছু দলের মধ্যে এমনও কথা আছে যে মহিলাদের তারা কিছুতেই সামনে আনতে চায় না। মহিলাদের তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, তারা সামাজিক ক্ষমতায়নও করতে চায় না।’’
এর পর এই প্রশ্নের উত্তরে মির্জা সাহেব বলেন,‘‘এসব দলের যদি উত্থান হয় এই দেশে, তাহলে তো পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।’’
ঐ সাক্ষাৎকারে মির্জা সাহেব অত্যন্ত স্পষ্ট করে বলেছেন যে, দক্ষিণপন্থীরা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হলে দেশ পিছিয়ে যাবে।
তাঁর কথায় সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হলে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঠেকিয়ে বামপন্থীদের উত্থান ঘটাতে হবে।
মির্জা সাহেবের এই বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বিএনপি এখন আগাগোড়া খাঁটি বামপন্থী দলে পরিণত হয়েছে এবং সেই কারণে বাংলাদেশে ডানপন্থীদের উত্থানে বিএনপি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
অথচ এতোদিন দেশবাসী জেনে এসেছেন যে, জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি দক্ষিণপন্থী তথা ডানপন্থী রাজনৈতিক দল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলেও জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বিএনপি দক্ষিণপন্থী ছিলো। বেগম খালেদা জিয়ার আমলেও সেই বিএনপি দক্ষিণপন্থীই ছিলো।
বর্তমান চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সময়ে এসে হঠাৎ করে দলটির মহাসচিব ডানপন্থীদের উত্থানে উদ্বিগ্ন হয়ে জাতীয়তাবাদী ইসলামী আদর্শে বিশ্বাসী বিএনপিকে দক্ষিণপন্থী থেকে রুপান্তরিত করে বামপন্থী হিসেবে জাহির করলেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে আগাড়গাড়া একজন খাঁটি বামপন্থী মানুষ। তাঁর মিশনই ছিলো ডানপন্থী বিএনপিকে বামপন্থীতে রূপান্তরিত করা। তিনি সেই মিশনে সফল হয়েছেন।
দু:খজনকভাবে বিএনপিতে এখন ভারতপন্থী, আওয়ামী পন্থী এবং বামপন্থীদের প্রভাব বেশি। প্রথম প্রজন্মের বিএনপি এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের বিএনপিতে ভারতপন্থী-আওয়ামী পন্থী এবং বামপন্থীদের অবস্থান থাকলেও তাঁরা কোনঠাসা অবস্থায় ছিলেন। এখন তৃতীয় প্রজন্মের বিএনপি চালাচ্ছে অতীতে ঘাপটি মেরে থাকা সেই ভারতপন্থী, আওয়ামী পন্থী এবং বামপন্থীরা। তাই ডানপন্থী বিএনপির এই বামপন্থীতে রূপান্তর হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বামপন্থীরাই এখন বিএনপি চালাচ্ছে বলে বিএনপির ‘ডানপন্থী প্রজন্ম’ চাপা পড়ে গেছেন। সম্ভবত সে কারণেই আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকেও দৃশ্যপটের আড়ালে রাখা হয়েছে।
একারণেই বিএনপির ত্রিকালদর্শী জনতা বিএনপির এই রূপান্তরে তেমন একটা হোঁচট খায়নি। তারা খুব সহজেই বিএনপির এই রূপান্তর মেনে নিয়েছেন।
তবে এতোদিন ধরে বিএনপির সঙ্গে পথ চলা মানুষের জিজ্ঞাসা, দক্ষিণপন্থী বিএনপির হঠাৎ করে বামপন্থীতে রূপান্তরের আসলে উদ্দেশ্য কী ?
এই প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবেন কেবলমাত্র বিএনপির মহাসচিবই। তবে মির্জা সাহেবের এই উদ্বিগ্ন হওয়ার বক্তব্যে আরো বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ।
আন্দোলনের মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব “দক্ষিণপন্থীদের উত্থান” সম্পর্কিত এক প্রশ্নে যেভাবে উত্তর দিয়েছেন, তাতে জনমনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুল বার্তা দেবে।
বিএনপির মহাসচিবের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুস আহমদ আরো বলেন, ‘আমরাও বাংলাদেশে রাজনীতি করছি। আমরা তো এমন কোনো শক্তির উত্থান দেখছি না। তিনি যদি এমন কোনো শক্তির উত্থান দেখেন, তাহলে তা পরিষ্কার করে বলা উচিত। কিন্তু তা না করে অনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে এমন নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করাকে আমরা অশুভকর বলে মনে করছি। তাঁর এই বয়ান পতিত ফ্যাসিবাদের বয়ানকে সমর্থন করে।’
ডানপন্থী বিএনপিকে বামপন্থীতে রূপান্তরিত করার আসল উদ্দেশই হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিতাড়িত ফ্যা.সিবাদের পূনর্বাসন করা। হাজার হাজার শহীদের রক্তে কেনা ২য় স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করা।
জোটবদ্ধ জাতির রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় অধিপত্যবাদ খতমের চেতনাকে নস্যাত করার জন্যই রক্তঝরা চব্বিশের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর থেকে পলাতক আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে সামনে আনার চেষ্টা চলেছে।
এবার সেই চেষ্টারই অনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছেন
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।