
বাবা কখনও আমাকে পরীক্ষায় ফার্স্ট হবার জন্য জোরাজুরি করেননি, তিনি শুধু বুঝতে চেয়েছেন স্কুলে আমি নতুন কিছু শিখতে পারছি কিনা। প্রত্যন্ত পল্লীগ্রামের এক অখ্যাত স্কুলে আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তখন আমরা গ্রামের বাড়িতেই থাকতাম। বাবা মফস্বল শহরের কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ক্লাস টু-তে ফাইনাল পরীক্ষায় আমি থার্ড হই। এতে মা ভয়ানক রেগে যান। ফার্স্ট হতে না পারার জন্য তিনি আমাকে ঢোল কলমি (এক ধরনের ছোট গাছ) দিয়ে ভালো রকম উত্তম মধ্যম দেন।
সন্ধ্যায় বাবা যখন বাড়িতে ফিরলেন তখন আমি বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছি। তিনি আমাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারা বা না পারার মধ্যে জীবনের সার্থকতা নির্ভর করে না। একজন মানুষের সফল বা ব্যর্থ হওয়া যতটা না তার মেধার ওপর নির্ভর করে, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
বলা বাহুল্য, জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার শিক্ষা বাবা আমাকে ছোটবেলা থেকেই দিয়েছিলেন। তিনি দরিদ্র মানুষ নন, তবুও তিনি আমাকে অভাব শিখিয়েছেন। কোনো জিনিস অন্তত তিনবার না চাইলে তিনি সেটা কানেই তুলতেন না। তিনবার বললেই যে পেয়ে যেতাম ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। তিনি তখন আমার চাওয়াটাকে বিবেচনায় নিতেন। তখন বাবার ওপর খুব রাগ হতো — এখন আর হয় না। কারণ এতদিনে আমি বুঝে গেছি তিনি ইচ্ছা করেই এমনটা করতেন। তিনি সবসময়ই বলতেন, “চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায় না, সবকিছু পাবার দরকারও নেই। চাওয়া মাত্রই যেসব ছেলেমেয়ে সবকিছু পেয়ে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা মানুষ হয় না।”
এখন আমার কাছে মনে হয়, ছোট ছোট না পাবার অতৃপ্তি মানুষের মধ্যে বড় কিছু পাবার ইচ্ছাশক্তি জাগিয়ে তোলে। কোনো কিছু চাইতেই পেয়ে যাবার পর আমাদের মস্তিষ্ক Satisfied হয়ে যায়। আর যখন আমরা সেটা পাই না তখন আমার মধ্যে আমাদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি জন্ম নেয়। অস্বস্তিটা একসময় আমাদের অবচেতন মনে (Subconscious mind) পৌঁছে যায়। তারপর সেখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। জীবনে সফল হতে গেলে এই অস্বস্তি জিনিসটা খুব দরকার। কারণ অস্বস্তি ছাড়া আমাদের মধ্যে প্রেরণা (Motivation) তৈরি হয় না। এজন্যই বোধহয় মাত্রাতিরিক্ত বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা প্রায় ক্ষেত্রেই উচ্ছন্নে যায়।
বাবা আমাকে কখনও বাজে সঙ্গে মিশতে নিষেধ করেননি। তিনি আমাকে যেটা বলতেন সেটা হচ্ছে, তুমি ভালো-মন্দ উভয়ের সাথেই চলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভালোটাকেই গ্রহণ করবে। যদি তোমাকে খারাপের সাথে মিশতে নিষেধ করি, তাহলে জগতের অন্ধকার দিকগুলোর প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার শিক্ষা তুমি পাবে না। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই-উৎরাই সম্পর্কেও তোমার ধারণা তৈরি হবে না। এটা শেষ পর্যন্ত তোমার ক্ষতির কারণ হতে পারে।
তাই কলেজ জীবনে আমার বন্ধুরা যখন লেটেস্ট মডেলের বাইক হাঁকিয়ে মেয়েদের কমন রুমের সামনে এসে সানগ্লাস খুলে দাঁড়ত তখন আমার মনে এতটুকু ঈর্ষা দানা বাঁধত না। আসলে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বিলাসবহুল গাড়ি, দামি ফ্ল্যাট, ডাইনিং টেবিল ভর্তি খাবার, নামী ব্রান্ডের ফোন — এসব দিয়ে সন্তানকে মানুষ করা যায় না। সন্তানকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাকে ‘জীবনের মানে” শেখাতে হয়।
বাবা আমাকে শৈশব থেকেই জীবনের মানে শেখাতে চেয়েছেন, আমি কতটুকু গ্রহণ করতে পেরেছি জানিনা। আজ জীবনের এই পর্যায়ে এসে এখনও আমি জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমার কাছে জীবন মানে পৌষের সকালে শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটা, ভরা বর্ষায় ডিঙি নৌকা করে খালে-বিলে ঘুরে বেড়ানো, হলুদ সরিষা ক্ষেতের আইলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা, পড়ন্ত বিকেলের ঝিরিঝিরি হাওয়ায় মাঠ দাপিয়ে ঘুড়ি ওড়ানো, নদীর তীর অসার করে ফেলা ঘন কুয়াশা, বাঁশবাগানে জোনাকির মিটিমিটি আলো, উথাল পাথাল জোৎস্না রাতের পুকুরঘাট, আঁধার করে আসা একটানা বৃষ্টি, আপনজনদের সাথে কাটানো সুন্দর একটা সন্ধ্যা। আমার কাছে জীবন মানে সাধারণ মানুষের সেবা করা।