
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস সর্বদাই দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম ও ক্ষমতার পুনঃবন্টনের এক নাট্যশালা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে সামরিক শাসন, গণআন্দোলন, নির্বাচন-কেন্দ্রিক সংঘাত — প্রতিটি ধাপেই দেশটির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো না কোনোভাবে চ্যালেঞ্জের মুখামুখি হয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে পরিবর্তনটি সবচেয়ে গভীর এবং আলোচিত হয়ে উঠেছে, তা হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের ধারা, যাকে অনেক বিশ্লেষক ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ’ বলে অভিহিত করছেন। এ ফ্যাসিবাদ শুধু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দমন নয়, বরং একটি রাজনৈতিক জোট-প্রক্রিয়াও বটে যেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এবার বিশ্লেষণ করা যাক, কীভাবে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের এই ফ্যাসিবাদী প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্রিয় বা নীরব সহযোগী হয়েছিল এবং এর রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক পরিণতিই বা এখন কেমন।
জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক উৎপত্তি এক সামরিক শাসকের হাত ধরে— হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদতের পর এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ১৯৮৬ সালে ‘গণতন্ত্রের ফিরিস্তি’ দিতে গিয়ে জাতীয় পার্টি গঠন করেন। তার শাসনামল ছিল একদিকে আমলাতান্ত্রিক উন্নয়নের প্রচার, অন্যদিকে রাজনৈতিক বিরোধী কণ্ঠ দমন এবং সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে এক নিপীড়নমূলক কাঠামো। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের ফলে এরশাদের পতন হলেও জাতীয় পার্টি রাজনৈতিকভাবে নির্মূল হয়নি; বরং একটি মধ্যম পন্থী ‘কিংস পার্টি’র ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বারবার ক্ষমতার কাছে থেকে গেছে। ২০০৮ সালের পর থেকে তাদের এই ভূমিকাই আবার নতুন মাত্রা লাভ করে।
২০০৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য ছিল একটি পুনর্জন্মের সুযোগ, যেখানে দলটি দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপর থেকে দেশের রাজনৈতিক চেহারাই পাল্টে যায়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার, ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাণ, সুশাসনের প্রতিশ্রুতি; অন্যদিকে শুরু হয় বিরোধী দল দমন, মিথ্যা মামলা, গুম-খুন, বিরুদ্ধ মতের ওপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ। অনেক বিশ্লেষক এই সময়কালকে ‘নতুন কর্তৃত্ববাদ’ বা ‘হাইব্রিড রেজিম’ নামে অভিহিত করেছেন। বিশেষ করে Freedom House, Economist Intelligence Unit, এবং V-Dem Institute- এর মতামত অনুসারে, বাংলাদেশ তখন অনেকাংশে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সূচকে অবস্থান করছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ল শ্রেণির মতো। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন ছিল একটি মোড় পরিবর্তনের মুহূর্ত। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল সেই নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচনের গণতান্ত্রিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অথচ জাতীয় পার্টি শেষ পর্যন্ত অংশ নেয়, এমনকি তাদের অনেকে একদিকে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে জায়গা করে নেয়, আবার অন্যদিকে মন্ত্রিসভায় শপথ নেয়। এটি ছিল একটি অভিনব রাজনৈতিক নাটক— যেখানে একটি দল সরকারেও আছে, আবার বিরোধী দল হিসেবেও সংসদে বিরাজ করছে। এই দ্বৈত ভূমিকা রাজনৈতিক বিজ্ঞানী Giovanni Sartori- এর “pseudo-opposition” বা ছদ্ম বিরোধী দলের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
জাতীয় পার্টির এই দ্বৈত নীতি কেবল মাত্র রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের জন্য নয়, বরং এক গভীর রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ। এ ধরনের ‘অনুগত বিরোধী দল’ রাখার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জহীন করতে পেরেছিল। কারণ, প্রকৃত বিরোধী দল গঠনে যেখানে প্রয়োজন হয় আদর্শ, আন্দোলন, ত্যাগ ও নেতৃত্ব, সেখানে জাতীয় পার্টি ছিল ‘কার্যকর নিরপেক্ষতা’র প্রতীক— যা ক্ষমতাসীন দলের জন্য আদর্শ বিরোধী কাঠামো।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের সংসদীয় কার্যক্রমে জাতীয় পার্টির বক্তব্যের ৮০ শতাংশই ছিল সরকারপন্থী। তাদের বক্তৃতায় সরকারের সমালোচনার চেয়ে সরকারের প্রশংসাই বেশি দেখা গেছে। অন্যদিকে সংসদে বিএনপি বা অন্যান্য বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে সংসদ কার্যত একমুখী হয়ে পড়ে। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভাষায় এটি ছিল ‘rubber-stamp parliament’— যেখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনাই হারিয়ে যায়।
জাতীয় পার্টির ভূমিকার আরেকটি দিক হলো রাজনৈতিক পরিসরে বিকল্প শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। তারা অনেক সময় বিরোধী দলীয় রাজনীতির নামে একটি ‘ভয়ের পরিবেশ’ তৈরি করে, যাতে করে জনগণের আসল বিরোধী শক্তির প্রতি আগ্রহ বা আস্থা তৈরি না হয়। জাতীয় পার্টির মধ্যে দিয়ে বিরোধী রাজনীতিকে ‘institutionalize’ করার এই কৌশলটি মূলত ক্ষমতাসীনদের ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই কার্যকর হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। রাজনীতি এখন আর জনগণের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার নয়, বরং হয়ে উঠেছে একটি সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যম। জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো যখন এই কাঠামোর অংশ হয়ে পড়ে, তখন রাজনীতিতে মতবিনিময়ের জায়গা সংকুচিত হয়, গণতন্ত্র হয় একমুখী এবং বিরোধী কণ্ঠ হয় প্রহসনের অংশ।
এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো— জাতীয় পার্টি আদৌ কি বিরোধী দল? তারা কি সরকারবিরোধী কোনো গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে? তারা কি সংসদে সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছে? কিংবা তারা কি কখনো জনগণের মৌলিক অধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে? উত্তর হলো— না। বরং তারা বরাবরই একটি ঘূর্ণায়মান দরজার মতো, যা সরকারের চাহিদা অনুযায়ী কখনো বিরোধী দলের ছদ্মবেশ নেয়, কখনো সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়।
উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে দেখা যায়, গণতন্ত্রের জন্য শুধুমাত্র নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, ন্যায়বিচার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, শক্তিশালী বিরোধী দল ও মিডিয়া— এসবই গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিত্তি। কিন্তু জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যকার এই ছদ্ম বিরোধী সম্পর্ক রাজনৈতিক ভারসাম্যকে দুর্বল করেছে, বিরোধী কণ্ঠকে বিকল করেছে, এবং দেশের রাজনৈতিক পরিসরকে সংকুচিত করে একটি প্রহসনমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।
পরিশেষে বলা যায়, ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ’ কায়েমের অভিযানে জাতীয় পার্টির ভূমিকাকে নিছক সহযোগিতা বলা যাবে না। বরং এটি ছিল একটি পূর্বপরিকল্পিত ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব। এই অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের জন্য এক ধরনের ব্যাধি, যা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তাইতো, আজ জাতীয় পার্টি পল্লী বন্ধুর স্থলে বাংলাদেশের শত্রুতে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের জাপার এহেন করুন অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।