সুলেখা আক্তার শান্তা
কোনোরকমে জীবন চালিয়ে অবশেষে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করেন আজাদ। এত বছর অন্যের জমিতে ঘর তুলে ছিলেন; মনটা সবসময় খচখচ করত। মৃত্যুর আগে অন্তত নিজের জমি, নিজের ঘরে ঘুমিয়ে মরতে পারলেই হবে। এই প্রত্যাশা বুক নিয়েই আছি। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বউ সালেহার সঙ্গে কথা বলছিলেন আজাদ।
সালেহা রান্নাঘরে বসে স্বামীর কথায় সায় দিলেন। “এই বুড়ো বয়সেও তোমাকেই কাজ করতে হয়। দুই ছেলে ঘর করেছে, বাবা-মাকে তাদের বাড়িতে তুলল না।”
আজাদ শান্ত গলায় বললেন, “যাক সালেহা, এসব নিয়ে আফসোস করো না! আল্লাহপাক আমাদের একটা নিজের জায়গা দিয়েছেন। এখন তুমি তোমার স্বামীর নিজের হাতে বানানো ঘরেই থাকতে পারবে। সালেহা বুঝলেন, নারীর কাছে স্বামীই যেন তার সব।
আজাদের বাবা–মায়ের পৈতৃক ব্যবসা ছিল লেপ-তোশক বানানো। সেই ব্যবসাই তিনি ধরে রেখেছেন। অন্য কোনো কাজ তিনি জানেন না, করতেও চান না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে লেপ-তোশক বানিয়ে দেন, কেউ অর্ডার দিলে বানিয়ে দেন, আবার নিজে বানিয়েও বিক্রি করেন। এটাই তাঁর বাপ-দাদার কাজ ছিল।
আজাদের এখন বয়স হয়েছে, আগের মতো আর তিনি কাজ করতে পারেন না। তবু কী করবে, কাজ না করলে খাবেন কী?
সালেহা স্বামীকে বারবার বলেন, “এই বয়সে আর কাজে যেয়েন না। না খেয়েই থাকব, তবু আপনার কষ্ট ভালো লাগে না।” আজাদ হাসতে হাসতে বলেন, “বউ পেট তো আর বোঝে না, পেটে তো খাবার দিবার লাগে। না থাকলে না খাইয়া থাকমু।” তারপর সালেহার দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলেন আজাদ, “তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো? তোমার এই ভালোবাসা নিয়েই তো বেঁচে আছি। না হলে টিকে থাকতে পারতাম না।”
সালেহা বিরক্ত হয়ে বলেন, “চুপ থাকেন আপনি। আমি আর আপনার লাইগা কী-ই বা করতে পারি?” আজাদ মাথা নাড়িয়ে বলেন, “না সালেহা, তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ভাগ্যে ভালো, তোমার মতো একটা বউ পেয়েছি।” “হয়েছে হয়েছে, এবার থামেন।” বলে সালেহা কথার ইতি টানলেন।
“বউ, ধুনকারি দাও”, সালেহা এগিয়ে দিলেন ধুনকারি। আজাদ লেপ–তোশকের বান্ডিল মাথায় নিয়ে বের হলেন। গ্রাম থেকে গ্রাম ঘুরে ডাকতে থাকলেন, “লেপ-তোশক বানাবেন নাকি? লেপ-তোশক বানাই!” কিন্তু কারো কাছ থেকেই সাড়া মিলছিল না।
হাঁটতে হাঁটতে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রাম পার হচ্ছিলেন আজাদ। বয়স হয়েছে, এখন আর মাথায় বোঝা নিয়ে আগের মতো হাঁটা যায় না। মনে মনে ভাবলেন, “এ কথা সালেহাকে বললে তো আর বেরুতে দেবে না। দু’জনের খাওন লাগে,কাজ না করলে চলবে কীভাবে?”
ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো—
“ওই লেপতোশকওলা!”
আজাদের মনটা খুশিতে ভরে গেল। “যাক, ডাকটা পেলাম অবশেষে!” তিনি বাড়িতে ঢুকতেই বললেন, “কি বানাইবেন মা?”
জাহানারা বললেন, “দুইটা তোশক আর দুইটা লেপ। দাম বেশি ধরবা না। তোমার লাভ যতটুক রাখবে রেখো। কাজ ভালো করলে তোমাকে আরো কাজ দেবো।”
আজাদ বিনয়ের সঙ্গে বলেন, “মা, আমি গরিব, তাই বলে কাউরে ঠকিয়ে না। ভালো কাপড় দেই, ভালো সেলাই করি।”
জাহানারা মাথা নাড়লেন, “ঠিক আছে, তুমি কাজ করো। আমি আমার ঘরের কাজ সেরে আসি।”
আজাদ উঠোনে বসে এক ধ্যানে মন দিয়ে কাজ শুরু করলেন। কিন্তু হাতটা ব্যথা করছিল, তুলা ঠিকমতো মারতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পর বললেন, “ঠিক আছে, বাড়ি যাই। বউরে নিয়ে দু’জনে মিলে কাজটা সেরে এনে দেই।”
তিনি সবকিছু গুছিয়ে নিলেন।
ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জাহানারাকে ডাকলেন আজাদ। কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পেলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললেন, “থাক, কতক্ষণই বা দাঁড়িয়ে থাকমু! তার চেয়ে বাড়ি যাই, সালেহাকে নিয়ে কাজটা শেষ করে এনে দেই।”
আজাদ বাড়ি ফিরে ডাকলেন, “কই গো সালেহা?”
স্বামীর ডাক শুনে সালেহা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
আজাদ বললেন, “ভালো একটা অর্ডার পাইছি। হাতটা ব্যথা করছে, ঠিকমতো কাজ করতে পারছিলাম না। ভাবলাম তোমারে নিয়েই কাজটা করি।”
সালেহা হেসে বললেন, “ঠিক আছে, দু’জনে মিলেই করি। তাহলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে।” দু’জনে উঠোনে সবকিছু বিছিয়ে কাজ শুরু করল। গল্প করতে করতে কাজ এগোতে থাকলো, তারপর শেষও হয়ে গেল।
আজাদ বললেন,“যাক, কাজটা শেষ হলো। এবার আমি নিয়ে যাই। আসার পথে, তাকে বাড়িতে পাইনি। এখনই দিয়ে আসি, দূরত্ব পায়।”
এদিকে জাহানারা বাড়িতে ফিরে এসে দেখেন—লেপ–তোশকওলা উঠোনে নেই। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “হায় হায়! লোকটার হাতে লেপ তোশক বানানোর কাজ দিয়ে গেলাম, আর সে না বলেই চলে গেল! আমি তো ভাবছিলাম খুশি করব, টাকাও বেশি দেব!”
জাহানারা আশেপাশে কয়েক ঘর গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “ওই লেপতোশকওলা কি তোমাদের বাড়িতে আসছে?”
সবার উত্তর এক, “না, আসে নাই।”
পাশে তখন ছিল দেবরের ছেলে ফরিদ।
“কি হয়েছে চাচি?” ফরিদ জিজ্ঞেস করল।
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বলিস না বাবা, এক বুড়ো মানুষরে লেপ তোশক বানাতে দিছিলাম। আমি একটু পাশের বাড়িতে গেছিলাম, ফিরে দেখি লোকটা হাওয়া!”
“তুই একটু খেয়াল করে দেখিস তো, কোথাও দেখলে ডাকিস।”
ফরিদ বলল, “ঠিক আছে চাচি, আপনি যান। আমি বাড়ির একটু কাজ সাইরা দেখি লোকটারে দেখি কিনা। পাইলে আপনিরে এনে দিমু।”
আজাদ যখন জাহানারার বাড়ির ভিতরে ঢোকার পথে, তখনই দেখা হলো ফরিদের সঙ্গে।
ফরিদ সন্দেহভরা চোখে জিজ্ঞেস করল “আপনি কি এই বাড়ির লেপ তোশকের অর্ডার নিয়েছিলেন?”
আজাদ হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন “হ্যাঁ বাবা…”।
মাথায় ভারী লেপ তোশোকের বোঝা, তার ওপর বয়স, ঠিকমতো কথাও বলতে পারছিলেন না। তিনি বাকিটা বুঝিয়ে বলার আগেই ফরিদ উত্তেজিত হয়ে উঠল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাঁশ কুড়িয়ে এনে রাগে-গরম হয়ে বৃদ্ধ লোকটার ওপর বাড়ি বর্ষণ শুরু করে দিলো।
আজাাদ কাঁপা গলায় বললেন “এই তুমি আমাকে মারছ কেন?”
ফরিদ চিৎকার করে বলল, “শালা চোর! সব নিয়ে পালাইছিস!”
আমি চোর না, আমি চোর না! আমি খেটে–খাওয়া মানুষ!” বুকে হাত চেপে কাঁপা গলায় বলতে থাকলেন আজাদ। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ফরিদের মাথা তখন রাগে অন্ধ। হঠাৎ এমন জোরে একটা বাড়ি দিলো বৃদ্ধ আজাদের মাথায়, সেই মুহূর্তেই মাথা ফেটে অঝোরে রক্ত ঝরতে লাগল! চারদিকে মানুষ জড়ো হতে থাকল।
“কি হইল? কি হইল?” লোকজন দৌড়ে এলো। ঘটনাটা জানতে চাইলো।
ফরিদ গলায় জোর দিয়ে বলল, “এই বুড়ো শালা চোর! আমার চাচি ওরে লেপ তোশক বানাইতে দিছিল। সবকিছু নিয়া পালাইছে!” রক্তে ভেজা চোখ তুলে আজাদ কাঁপা কণ্ঠে বললেন,“না… না, আমি কিছু নিয়া পালাই নাই… আমি বলতে চাইছিলাম… কিন্তু তাঁরে বাড়িতে পাই নাই। পরে বাড়ি গিয়া আমার বউরে নিয়াই এই লেপ তোশক বানাই নিয়া আইছি।
কথা বলতে বলতে আজাদের শ্বাস ঢিলা হয়ে এলো—পরান যায় যায়।
এসময় আশেপাশের লোকেরা ফরিদকে ধমক দিলো, “তোর জন্যই বুড়ো লোকটার এই অবস্থা! না জেনে মানুষেরে এমনে মারবি?”
লোকজন ফরিদকে ধমক দিচ্ছিল। “তাঁর কথা শুনতে তো পারতি! এত তাড়াহুড়া কেন?”
ঠিক তখনই দৌড়ে এসে উপস্থিত হলেন জাহানারা। দৃশ্য দেখে তিনি হা করে উঠে বললেন,
“হায় হায়! এই বুড়ো মানুষটা কে তার জন্যে এইভাবে মারবি!”
তৎক্ষণাৎ একটা ভ্যান ডেকে আজাদ কে হাসপাতালে নেওয়া হলো। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ—আজাদ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন!
খবর পেয়ে সালেহা ছুটে এলেন। স্বামীর নিথর দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। “আপনারা কিছু না জেনে, না শুনে একটা মানুষকে মাইরা ফেললেন! আপনাদের কী হারাইছে? আমি তো আমার স্বামীকে হারালাম!”
জাহানারা কাঁদতে কাঁদতে টাকা দিতে চাইলে সালেহা দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “আমি লাশ বিক্রি করে টাকা নিতে আসিনি! আমার স্বামীরে ফিরে পাব না। হ্যাঁ, টাকার দরকার আছে… কিন্তু মানুষের জীবনের বদলে টাকা, এইটা আমি নেব না।”
স্বামীর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সালেহা।
বাবার মৃত্যুর খবর শুনে দুই ছেলে তাদের বউ নিয়ে বাড়ি এলো।
সালেহা বললেন, “আমার স্বামীর কবর এই উঠোনেই দাও। ঘরে বসে যেন তাঁর কবর দেখতে পাই”।
দুই ছেলে বাবার দাফন সেরে চলে গেল।
সালেহা নিঃসঙ্গ বাড়িতে বসে রইলেন।
নিজের সঙ্গে নিজেই বললেন, “আমি যাবো কই? আমার স্বামীর বাড়িই আমার বাড়ি। এই বাড়িতেই আমি মরতে চাই।”

