বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ক্ষমতাচ্যুত পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে। এই রায় দেশের রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই আদালতই এবার বাংলাদেশের এক দীর্ঘমেয়াদি ফ্যা.সিস্ট শাসকের বিচার করতে পারায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের একটা স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গন্তব্যেরও একটা পথরেখার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষনার পর ভারত এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়ন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে,ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নীরব থাকলেও শীঘ্রই সরব হবে। তবে,ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের দীর্ঘ ইতিহাস বিবেচনায় ভারত এখন খুব সংযমী অবস্থান নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ দিল্লির দীর্ঘমেয়াদি ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত মূলত আওয়ামী লীগের মতো ফ্যা.সিবাদী দল এবং হাসিনার মতো একজন ফ্যা.সিস্টকে দিয়েই দীর্ঘ ১৬ বছর বাংলাদেশকে শাসন ও শোষণ করেছে।
ভারতের সরাসরি ইন্ধনেই শেখ হাসিনা মানবতাবিরাধী দানব এবং ফ্যা.সিস্ট হয়ে উঠেছিলেন। ভারতের সরাসরি ইন্ধনেই শেখ হাসিনা নির্মম গণ.হত্যা চালিয়েছেন। এজন্য শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় ঘোষণার পর ভারত আপাতত নিরব থাকলেও শীঘ্রই যে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ভারত এখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে সরাসরি ইন্ধন যোগাবে। ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো ব্যবহার করেও বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য বাংলাদেশের সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।
হাসিনার ফাঁসির রায়ের আইনি বিশ্লেষন
শেখ হাসিনা ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় ছিলেন। যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক যুগান্তকারী অধ্যায়।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকদের মতে, এ সময় তিনি রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়ীকরণের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেন। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী ক্ষমতাকাঠামো গড়ে ওঠে, বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয় এবং একর পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনার সরকার পতন ঘটে। সেই অস্থিরতার মধ্যেই নতুন অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে উচ্চমাত্রার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে।
হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার কেন্দ্রে ছিল মূলত কয়েকটি প্রধান অভিযোগ
প্রথমত : গুম ও হত্যার অভিযোগ
রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের আটক, গুম ও হত্যায় অনুমোদন বা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।
দ্বিতীয়ত : নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ
২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় পর্যন্ত বহু ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর “অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ” প্রসঙ্গে আদালত বিশেষ গুরুত্ব দেয়।
তৃতীয়ত: দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার
সরকারের উচ্চস্তরে দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। এসব অভিযোগও মামলায় উঠে আসে, যদিও আদালত প্রধানত মানবাধিকার–সম্পর্কিত অভিযোগকেই বিবেচনায় নিয়েছে।
হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছে সেগুলো হলো-
কমান্ড রেসপনসিবিলিটি
অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত অপরাধের সর্বোচ্চ দায়িত্ব সরকারের প্রধানের ওপর বর্তায়। একারণেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
ক্রাইমস এগেইনস্ট হিউম্যানিটি
হত্যা, নির্যাতন, গুম, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে অপরাধ হিসেবে গণ্য। হত্যা, নির্যাতন, গুম, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মতো অপরাধগুলো নিশ্চিতভাবে প্রমানিত হওয়ায় হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রদান ছাড়া আর অন্যকোন বিকল্প ছিলো না।
চেইন অব কমান্ড
বিশেষ কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে আদালত সরাসরি যোগাযোগ, নির্দেশ ও অনুমোদনের প্রমাণ পেয়েছে বলে দাবি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একারণে হাসিনার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় হয়েছে
এই রায়ের ফলে বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবহ তৈরি হয়েছে। এই রায় ইঙ্গিত দিচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসকের পতন এবং বিচার রাজনৈতিক ক্ষমতার চিত্র পাল্টে দিতে পারে। সেই সঙ্গে পাল্টে যেতে পারে রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
বাংলাদেশ এখন একটি পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আরো শক্তিশালী করা না যায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে দীর্ঘদিনের জনআকাঙ্খা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
তবে এই রায় থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নিলে এটি হয়তো নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনাও হতে পারে।
